ব-দ্বীপ
খানিক-ক্ষণের জন্য ভূগোল পড়তে আগ্রহী হয়েই আজকের এই আলোচনা । আমাদের আলোচনা বদ্বীপ নিয়ে । এবং সেটা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ । অর্থাৎ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গঠন নিয়ে ।
ব-দ্বীপঃ
নদীর মোহনায়; যেখানে নদী, সাগর বা হ্রদের সাথে মিলিত হয়, নদীর গতিবেগ যেখানে খুবই কম, সেখানে নদীতে জমে থাকা কাদা, পলি, বালি যদি একটি মাত্রাবিহীন “ব” বা গ্রীক অক্ষর ডেল্টা (∆) এর মতো অবস্থিত হয় তবে তাকে ব-দ্বীপ বলে। উদাহরণ: গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ।
ব-দ্বীপের নামকরণ:
ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (৪৮৫ – ৪২৫ খৃ. পূর্ব) নীল নদের মুখে ত্রিভুজাকার ভূখণ্ড দেখেছেন এবং এটিকে গ্রীক অক্ষর ডেল্টা (∆) এর সাথে তুলনা করেছেন, ভূখণ্ডটির নাম ডেল্টা। তার অনুসরণে বাংলাদেশে যে আকৃতিটির নাম হয় বাংলায় ব-দ্বীপ।
একটি ব-দ্বীপ হল একটি প্রাকৃতিক ভূমি, যা নদীর মুখে দীর্ঘমেয়াদী হিমায়িত পলি বা ফ্লুভিয়াল মাটি দ্বারা গঠিত একটি দ্বীপ। যখন একটি নদী জলাধার, হ্রদ, সমুদ্র বা মহাসাগরে প্রবাহিত হয়, তখন নদীর মুখে একটি ‘ব’ আকৃতির-দ্বীপ তৈরি হয়। এটি ব-দ্বীপ।
সহজভাবে বলা যায়,ব-দ্বীপ আসলে এক ধরনের প্রাকৃতিকভাবে গঠিত ত্রিভুজাকার ভূমি, যেটি নদীর মোহনায় (সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকা) পলি মাটি জমা হওয়ার ফলে তৈরি হয়। সহজ কথায়, নদীর পানিতে ভেসে যাওয়া পলি দ্বারা সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি এলাকায় যে মাটি জমা হয়ে ভূমির সৃষ্টি হয় তাকে ব-দ্বীপ বলে।
আমাদের হিমালয় অববাহিকায়, গঙ্গা (বাংলাদেশের পদ্মা) এবং যমুনা, মেঘনা নদীর সাথে মিলে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ গঠন করেছে। প্রকার অনুসারে, বঙ্গীয় ব-দ্বীপ ত্রিভুজাকার ব-দ্বীপ শ্রেণীর অন্তর্গত।
কিভাবে ব-দ্বীপ গঠিত হয়ঃ
যে নদীগুলি পলিমাটি বহন করতে পারে সে নদীগুলি প্রধানত তিনটি উপায়ে ব-দ্বীপ গঠন করতে পারে;
- প্রথমত: যদি নদী একটি স্থির কোন জলাধার যেমন, হ্রদ, উপসাগর, সাগর বা মহাসাগরে পতিত হয় তখন সেখানে ব-দ্বীপ গঠিত হয়।
- দ্বিতীয়ত: যদি একটি নদী আরেকটি নদীর সাথে মিলিত হয় এবং দ্বিতীয় নদী যদি প্রথম নদীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারে এবং সেখান থেকে পলিমাটি সরাতে না পারে তখনও সেখানে ব-দ্বীপ গঠিত হয়।
- এবং তৃতীয়ত: একটি ভূমধ্য- অঞ্চল যেখানে নদীর পলি স্থলভাগে ছড়িয়ে পড়ে সেখনেও ব-দ্বীপ গঠিত হয়।
এই ব-দ্বীপের আয়তন৭৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার বলে অনুমান করা হয় তবে কেউ কেউ এটি ৮০,০০০ বর্গ কিলোমিটার বলে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ। এই ব-দ্বীপটি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ, সুন্দরবন ব-দ্বীপ, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ব-দ্বীপ এবং সবুজ ব-দ্বীপ নামে পরিচিত।
বাংলাদেশকে ব-দ্বীপও বলা হয় কারণ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের অধিকাংশই বাংলাদেশে অবস্থিত এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি প্লাবন সমভূমির অন্তর্গত এবং ব-দ্বীপ আকারের বলে ।
বঙ্গীয় ব-দ্বীপ(বাংলাদেশ) সৃষ্টির ইতিহাসঃ
প্রায় সাড়ে বারো কোটি বছর আগে, ক্রিটেসিয়াস যুগে, ভারতীয় প্লেট, বাংলাদেশের কিছু অংশ (বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল) সহ অ্যান্টার্কটিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাথে যুক্ত হয়ে গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে একটি বৃহৎ মহাদেশ গঠন করে। বাংলাদেশের বাকি অংশ তখন ছিল না। পরবর্তীতে গন্ডোয়ানাল্যান্ডে ভাঙনের ফলে ভারতীয় প্লেট উত্তরমুখী হয় এবং অবশেষে এশিয়ান (ইউরেশিয়ান) প্লেটের সাথে এর সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালা এবং বাংলাদেশের ব-দ্বীপ সমভূমির সৃষ্টি হয়।
সাধারণত ৩ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে ২টি প্লেটের সংঘর্ষ হয়:
২.ভূমিকম্প
৩. অথবা, যখন ২ টি প্লেট সংঘর্ষ হয়, তখন একে অপরের উপর চাপের ফলে মাঝখানের ভূমি উপরে উঠে যায় এবং পর্বত তৈরি করে।
আর এভাবেই ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে হিমালয়, অন্নপূর্ণাসহ বিশ্বের বিখ্যাত পর্বতমালা তৈরি হয়েছে।
ভারতীয় প্লেট এবং এশীয় (ইউরেশিয়ান) প্লেটের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক সংঘর্ষ প্রথম ঘটেছিল ইওসিন যুগে (৫ কোটি বছর আগে), যখন হিমালয় তৈরি হতে শুরু করেছিল। ভারতীয় প্লেট এবং এশিয়ান প্লেটের মধ্যে টেথিস সাগরের শেষ চিহ্নটি সম্ভবত শেষ ইওসিনের সময় (৪কোটি বছর আগে) অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এই সময়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের সাথে ভারতীয় প্লেটের অভিসারণের দিক অর্থাৎ উত্তর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ওলিগোসিন যুগ থেকেও (সাড়ে তিনকোটি বছর আগে) প্লেটের সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল এবং বৃহৎ নদী অববাহিকাদক্ষিণে আদি বঙ্গীয় অববাহিকা ভরে উঠে ব-দ্বীপের সৃষ্টি করে এভাবেই গড়ে উঠে ব-দ্বীপ ।
এরপর এই অঞ্চলে হিমালয় থেকে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। মাইওসিন-পরবর্তী সময় থেকে (আড়াই কোটি বছর আগে ও তার পরবর্তী) অববাহিকায় দ্রুত নিম্নচাপ এবং হিমালয় মালভূমির দ্রুত উত্থানের ফলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের সাথে বৃহৎ আকারের ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ নামের এই মহা ব-দ্বীপ গঠনের প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত রয়েছে। আর এটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে স্বীকৃত। যাকে আমরা বলি আমাদের নিজ দেশ, নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর এই হল ব-দ্বীপের অতি সংক্ষেপ সারমর্ম ও ইতিহাস।
আরও পড়তে
ক্ষুব্ধ দুঃখী ও হতাশাগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম
নওগাঁয় ‘কাঠের মাইক্রো প্রাইভেটকার ‘ তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন শামসুদ্দিন
ছাত্রলীগ নেতাদের পিটিয়ে দাঁত ফেলে দিয়ে ধরা খেলেন এডিসি হারুন: হলেন সাময়িক বরখাস্তঃ নেপথ্যে…নারী?