মহান বিজ্ঞানী (আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ) আল বেরুনী
আল বেরুনীর জন্ম
আল বেরুনী ১৯৭৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ইরানের বেরুন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ। কিন্তু প্রথা অনুযায়ী জন্মস্থানের নামের সঙ্গে তার নাম যোগ করা হয়। ইতিহাসে তিনি আল বেরুনী নামে বেশি পরিচিত।
আল বেরুনীর শৈশব
আল বেরুনীর শৈশব কেটেছে রাজা আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরাকের তত্ত্বাবধানে। তিনি তার জন্য নিযুক্ত শিক্ষকের কাছ থেকে পবিত্র কোরআন ও হাদিস শিখেছেন। পরবর্তীতে তিনি বিজ্ঞানের সকল শাখায় নামকরা পণ্ডিতদের কাছ থেকে সকল বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ২২ বছর বয়স পর্যন্ত বাদশাহ আবু মনসুর বিন আলী বিন ইরাকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এই সময়ে তিনি জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে একজন বিখ্যাত পণ্ডিত হয়ে ওঠেন।
রাজা কাবুসের তত্ত্বাবধানে জ্ঞানসাধক
যদিও আব্বাসীয় রাজবংশের খলিফারা তখন মুসলিম বিশ্বের নেতা ছিলেন। কিন্তু খলিফাদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার কারণে মুসলিম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অশান্তি দেখা দেয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন রাজাদের আবির্ভাব ঘটে। সে সময় আল বেরুনী খাওয়ারিজম ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি জুরজান নামক রাজ্যে পৌঁছে সেখানে বাদশাহ কাবুসের চোখে পড়েন। রাজা জানতে পারলেন এই পরিব্রাজক বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত আল বেরুনী। তার কথা জানতে পেরে রাজা তাকে তার দরবারে নিয়ে আসেন। রাজা কাবুস জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা করতেন এবং তিনি বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের খুব পছন্দ করতেন।
আল বেরুনী তার অভিভাবক রাজাকে কখনো ভুলতে পারেননি। রাজা কাবুসের সাথে থাকার সময় তিনি ‘আসারুল বাকিয়া’ এবং তাজরি দুস শুয়াত নামে দুটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ, তিনি তার আমারুল বাকিয়া বইটি রাজা কাবুসের নামে উৎসর্গ করেন।
খাওয়ারিজমে ফেরত যান বিজ্ঞানী
খাওয়ারিজমের রাজা সুলতান মামুন বিন মাহমুদ জ্ঞানীদের কদর করতেন । আল বেরুনী সম্পর্কে জানার পর, তিনি তাকে তার দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। আল বেরুনী ১০১১ সালে সুলতানের অনুরোধে মাতৃভূমি খাওয়ারিজমে ফিরে আসেন। সুলতান তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আল বেরুনী বিজ্ঞান চর্চা ও সাধনা চালিয়ে যান। এই সময়ে তিনি মান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ৬/৭ বছর পর্যন্ত খাওয়ারিজমে ছিলেন। আল বেরুনী এ সময় বিভিন্ন বিজ্ঞানের বই লিখেছেন।
গজনীর সুলতান মাহমুদের দরবারে
গজনীর সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী-গুণীদের সম্মান করতেন। দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণীদের মধ্যে তাঁর দরবারে প্রতিদিন বিজ্ঞান-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। সুলতান মাহমুদের অনুরোধে আল বেরুনী ১০১৬ থেকে ১০১৯ সাল পর্যন্ত সুলতান মাহমুদের সঙ্গী হিসেবে গজনীতে অবস্থান করেন। আল বেরুনী সুলতান মাহমুদের সাথে কয়েকবার ভারত সফর করেন। সে সময় ভারতে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের ঐশ্বর্য দেখে তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১০১৯ থেকে ১০২৯ সাল পর্যন্ত মোট দশ বছর ভারতে অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি ভারতের জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতদের সাথে ভূগোল, গণিত এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ভারত থেকে ফিরে তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল হিন্দ’ রচনা করেন। কিতাবুল হিন্দ সেই সময়ের ভারতীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় নিয়মকানুন জানার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ছিল ।
আল বেরুনী ভারত থেকে গজনীতে ফিরে আসার পরপরই সুলতান মাহমুদ মারা যান। তার পুত্র মাসুদ ১০৩১ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান মাসুদও আল বেরুনীকে খুব সম্মান করতেন। এ সময় আল বেরুনী ‘কানুনে মাসুদী’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি তার সেরা বই। সুবিশাল এ বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে জ্যোতির্বিদ্যা,
- তৃতীয় খণ্ড ত্রিকোণমিতি,
- চতুর্থ খণ্ড জ্যামিতিক জ্যোতির্বিদ্যা,
- পঞ্চম খণ্ড গ্রহ, দ্রাঘিমাংশ, চাঁদ ও সূর্যের আকার,
- ষষ্ঠ খণ্ডে রয়েছে গ্রহের গতি, সূর্য,
- সপ্তম খণ্ডে রয়েছে চাঁদের গতি,
- অষ্টম খণ্ডে রয়েছে চাঁদের আবির্ভাব ও গ্রহন সম্পর্কে,
- নবম খণ্ডে স্থির নক্ষত্র সম্পর্কে,
- দশম খণ্ডে রয়েছে ৫টি গ্রহ
- এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে একাদশ খন্ডে।
বইটির নামকরণ করা হয়েছিল সুলতান মাসুদের নামে এবং তিনি খুশি হয়ে অনেক মূল্যবান রৌপ্য মুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন। আল বেরুনী সেই রৌপ্য মুদ্রাগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন। কারণ, তিনি কখনোই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো সম্পদ রাখেননি।
বিজ্ঞানে আল বেরুনীর অবদান
আল বেরুনী মানব জাতির জন্য বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। তাঁর বইগুলিতে তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, সমুদ্র তত্ত্ব এবং আকাশ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত আল বেরুনির জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। তারা বলেন, আল বেরুনী নিজেই একটি বিশ্বকোষ। তিনি একজন ভাষাবিদও ছিলেন। তিনি আরবি, ফার্সি, সিরিয়ান , গ্রীক, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষার পণ্ডিত ছিলেন।
কোপার্নিকাস বলেছিলেন যে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলি সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর আগে আল বেরুনী বলেছিলেন পৃথিবী বৃত্তিক গতিতে ঘোরে । তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অংকের গননায় ভুল ধরে দিয়ে তার সঠিক সমাধান দিয়েছেন । তিনিই প্রথম অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেন। । তিনি সর্ব প্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণাও আর্টেজিয় কূপের রহস্য উদঘাটন করেন । তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেন। তিনি অ্যারিস্টটলের বই ‘হেভেন’-এ ১০ টি ভুল চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন।
আরও পড়ুন
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনক প্রভাবশালী মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে হায়সাম
পৃথিবীকে উপভোগ করতে চাইলে ফজরের নামাজ পড়ুন: অভিনেতা সিদ্দিক
আল-বিরুনি ওষুধের উপর একটি অমূ ল্য বই লিখেছিলেন, যেখানে তিনি অনেক রোগের ওষুধ তৈরির শিল্প নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি মোট ১১৮ টি বই লিখেছেন। তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এমনকি ইতিহাসের উপর বই লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম ‘কিতাবুল তাফহীম’। এটি ৫৩০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে তিনি সংখ্যা, জ্যামিতি এবং পৃথিবীর গঠন নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি ‘আল আরসুল বাক্বিয়া’ আলাল কুবানিল কালিয়া’ গ্রন্থে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাঁর আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল জেজ আব্যান্ড (অন দ্য অ্যাস্ট্রোনমি) এবং আল ফি জেজ খাওয়ারিজমি (অন লজিক)।
আল-বিরুনী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের একজন। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান তার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের মৌলিক আবিষ্কারের উপর নির্মিত। তাদের অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা এবং ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই । বিজ্ঞানে তাদের অবদানকে স্বীকার করা সঠিক এবং যৌক্তিক কাজ।
এত বড় আলেম হওয়ার পরও আল-বিরুনি ছিলেন একজন সৎ ও ভালো মানুষ। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তার অন্তরে কোন অহংকার বা অহংকার ছিল না। তিনি সঠিকভাবে নামাজ পড়তেন ও রোজা রাখতেন এবং ইসলামের সকল বিধি-বিধান মেনে চলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার অর্জিত জ্ঞান খুবই কম। আল্লাহ সকল জ্ঞানের উৎস।
আল বেরুনীর মৃত্যু
আল বেরুনী ৬৩ বছর বয়সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসার পরও তিনি সুস্থ হতে পারেননি। অবশেষে তিনি ১৩ ডিসেম্বর ১০৪৮ সালে ৭৫ বছর বয়সে মারা যান