আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনক প্রভাবশালী মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে হায়সাম
ইবনে হায়সাম ছিলেন আলোকবিদ্যায় একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। পশ্চিমারা তাকে আল হাজেন নামে চেনে। তিনি ৯৬৫ সালে ইরাকের বসরাতে একটি ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষার পর তিনি বসরা শহরের গভর্নর নিযুক্ত হন। তারপর বিজ্ঞান ও অন্যান্য গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রচিত আল মানাজির বা বুক অফ অপটিক্স, পদার্থবিদ্যার সাত খণ্ডের বই, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকার সমতুল্য বলে বিবেচিত হয়।
তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর ওপর পড়লে সেই বস্তুটি দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এই বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আবিষ্কার করেন যে কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে প্রবেশ করলেই আমরা দেখতে পাই। তার বই ‘বুক অফ অপটিক্স’ এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তক। তার সম্মানে চাঁদের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয়েছে আল হাজেন। ২০১৫ সালে আলোর আন্তর্জাতিক বছরটি ইবন আল-হাইথামের আলোকবিজ্ঞানের উপর কাজ করার ১০০০ তম বার্ষিকীকে চিহ্নিত করেছে। এই মুসলিম নক্ষত্র ১০৪০ সালে অস্তমিত হয়।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। এই যুগে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অভূতপূর্ব আবিষ্কার হয়েছে। তিনি আলোকবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, দর্শন , আবহাওয়াবিদ্যা, আলোকবিদ্যা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মুসলিম বিজ্ঞানীকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক বলা হয়।
বিশ্বকে বিভিন্ন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন উপহার দিয়েছেন এমন মহান চিন্তাবিদদের একজন হলেন মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে হায়সা( আল-হাজেন।) তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ।
যে কোনো গবেষণায় প্রামাণ্য প্রমাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তার একটি উদ্ধৃতি পাওয়া যায় । যা তাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, “যদি একজন বিজ্ঞানী প্রকৃত সত্য আবিষ্কার করার লক্ষ্য রাখেন, তবে তাকে অবশ্যই নিজেকে তার সমস্ত কিছুর শত্রু করে তুলতে হবে।”
অন্য কথায়, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোথাও কিছু পড়লেই বিশ্বাস করার সুযোগ নেই; বরং তার স্বপক্ষে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ থাকলেই তা বিশ্বাস করা যায় এবং তা প্রমাণিত হয়।
তিনি দৃষ্টিবিজ্ঞান (অপটিকস), আলোকবিজ্ঞান ও আলো সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন।
অপটিক্সের বই বা কিতাবুল মানাজির (দ্য এস্প্যাক্টিবাস) এর ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে তার ধারণা রেনেসাঁর সময় ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রভাবিত করেছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীতে কিতাবুল মানাজিরের একটি ল্যাটিন অনুবাদ অধ্যয়ন করে, বিস্মিত হয়েছিলেন তৎকালীন ইউরোপের মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী (যন্ত্রবিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি বিষয়ে খ্যাত) রজার বেকন, বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী রবার্ট গ্রোসটেস্ট , খ্রিস্টান ভিক্ষু, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক, গণিতবিদ ভিটেলন প্রমুখ ।
আরও পড়ুন
সৌন্দর্য ঐতিহ্য আয়া সোফিয়ার ইতিহাস
বিখ্যাত ফিলিপিনো টিকটক নির্মাতা ফিওনা জেমসের ইসলাম গ্রহণ
শুধুমাত্র একজন পদার্থবিদ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কায়রোর ফাতেমীয় খলিফাদের সান্নিধ্যে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন গবেষণামূলক বই লিখে এবং অভিজাতদের শিক্ষা দিয়ে জীবিকা অর্জন করেন।
তিনি ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিমের (৯৯৬-১০২১) শাসনামলে কায়রোতে এসেছিলেন, যার বিজ্ঞান, বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যায় প্রবল আগ্রহ ছিল। নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ইবনে হায়সাম খলিফার কাছে একটি হাইড্রোলিক জলবাহী প্রকল্পের প্রস্তাবও করেন। এতে বিদ্যমান আসওয়ান বাঁধের জায়গায় একটি বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। তবে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে পরিকল্পনাটি কারিগরিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এরপর তিনি সারাজীবন কায়রোর বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থেকে যান। এই সময়ে তিনি তার বিখ্যাত বই বুক অফ অপটিক্স এবং জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, পাটিগণিত, আলোকবিদ্যা এবং প্রকৃতির দর্শনের উপর বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।
এই মহান মুসলিম বিজ্ঞানীকে কেউ কেউ আলোকবিদ্যার জনক বলে দাবি করেন। তার একটি আবিষ্কার হল-
পিনহোল ক্যামেরা । এটি বিশ্বের প্রথম ক্যামেরা। এটি আজকের আধুনিক ক্যামেরার পথিকৃৎ। এটি একটি লাইট-প্রুফ কাঠের বাক্স। এর একটি পৃষ্ঠে একটি ছোট গর্ত ছিল, ঠিক একটি পিনের আকার। তাই এই ক্যামেরার নাম ছিল পিনহোল ক্যামেরা। একটি বস্তুকে ছিদ্রযুক্ত পৃষ্ঠের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে এর ছায়া ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে এবং বিপরীত পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়েছিল। সেই সময়ের পিনহোল ক্যামেরার সাহায্যে এভাবেই একটি বস্তুর প্রতিফলিত রূপরেখা পাওয়া গিয়েছিল। কখনো কাঠের বাক্স, কখনো ঘর, কখনো দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে ক্যামেরা হিসেবে।
ক্যামেরা অবসকুরাও আবিষ্কার করেছিলেন । এটি পিনহোল ক্যামেরার মতো। তবে এর কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে অগ্রগামিতাও ছিল বেশ।
মধ্যযুগীয় বিজ্ঞানীদের মতে, ইবনে হাইসাম বিভিন্ন বিষয়ে দুই শতাধিক বই লিখেছেন, যার মধ্যে অন্তত ৬৯ টি বৈজ্ঞানিক কাজ পরিচিত। তার বেশিরভাগ কাজ সময়ের কাছে হারিয়ে গেছে, তবে প্রায় ৫০ টি আধুনিক মানুষের কাছে এখনো রয়েছে। এই কাজগুলির বেশিরভাগই গণিতের উপর, ২৩ টি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এবং ১৪ টি আলোকবিদ্যার উপর। সমস্ত কর্ম এখনও সঠিকভাবে মূল্যায়ন এবং গবেষণা করা হয়নি।
3 Comments