৩০ দিনে বিএনপি-জামায়াতের ৬০০ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড
গত এক মাসে বিএনপি-জামায়াত ও অঙ্গ সংগঠনের ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এত অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া বাংলাদেশে বিরল।
মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে তার বেশির ভাগই নাশকতার অভিযোগে। গত কয়েক বছরে এসব মামলা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে রাস্তায় জড়ো হওয়া, ভাঙচুর, জানমালের ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও যানবাহনে ভাঙচুর, পুলিশকে লাঞ্ছিত করা এবং দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে, আদালত জানুয়ারী ২০১২ থেকে নভেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে দায়ের করা ৩০ টি মামলায় অনেককে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
গত মাসে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ৬১০ জনের মধ্যে রোববার ৭৩ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার বংশাল, কলাবাগান ও কোতোয়ালি এলাকায় নাশকতার মামলায় ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের কারাগারে রাখা হয়।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, ঢাকার বংশাল থানায় দায়ের করা একটি মামলায় আদালত ২৫ বিএনপি নেতাকর্মীকে দুটি পৃথক ধারায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ শেখ সাদী এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার সময় আসামিদের কেউ আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। বিচার চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের চারজন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
২০১৩ সালের নভেম্বরে, ঢাকার আরেকটি আদালত কলা বাগানে নাশকতার দায়ে ৪০ জন বিএনপি কর্মীকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ঢাকা মহানগর হাকিম এ মামলায় ২৬ আসামিকে খালাস দেন। আলী হায়দার মামলার বিচার চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের ছয়জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
এ ছাড়া অবরোধকালে নাশকতার অভিযোগে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার অপর একটি মামলায় বিএনপির আট নেতাকর্মীকে দেড় বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এ রায় ঘোষণা করেন। এ মামলায় ১২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেওয়া হয়। মামলার শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের চার ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন।
গত এক মাসে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও রয়েছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, দলটির সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু প্রমুখের সাজা হয়েছে।
বিএনপির দাবি, এসব মামলার বেশিরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিএনপি নেতাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে জনপ্রিয় প্রার্থীদের সাজা দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে বিচার বিভাগ বিশেষ করে নিম্ন আদালত বিএনপি নেতা-কর্মীদের সাজা ও কারাদণ্ড নিয়ে জনগণের কাছে ভুল বার্তা দিচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট আদালতের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করছি।’
এদিকে,
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ঘরের বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই। কারাগারগুলোও পরিণত হয়েছে মৃত্যু উপত্যকায়। দেশের ৬৮ টি কারাগারই এখন টর্চার সেল। যেখানে রাজনৈতিক বন্দিরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ে বসবাস করে। সোমবার দুপুরে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার তাদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে গোটা দেশকে নরকে পরিণত করেছে। ঘরের বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত নয়। সরকার বিরোধীদের জীবন রাষ্ট্রীয় নজরদারি-বন্দুকের নলের মধ্যে রাখা হয়েছে । কারাগারগুলোও বাইরের মতো মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।।
যেখানে রাজনৈতিক বন্দিরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ে বসবাস করে। সেখানে সুস্থ নেতাকর্মীদের গায়েবি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তারপর তাদের লাশ বের হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছে সারি সারি লাশ।
তিনি বলেন, সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শেখানো বুলির বানানো ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। কারাগারে বন্দি অসুস্থ বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি করে তাদের জীবন বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করা হয় না। দেশে বিরোধী শক্তিকে নির্মম দমন-পীড়নের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযানের অংশ হিসেবে কারাগারে বন্দি বিএনপি নেতাকর্মীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
রিজভী বলেন, কেউ যাতে টু করতে নাপারে সেজন্য কারাগারের ভেতরে-বাইরে বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাদের প্রাণ কেড়ে নিতে নানা রকম অমানবিক আচরণ চলছে। বন্দিদের ওপর অবর্ণনীয় বীভৎস নির্যাতন করা হচ্ছে। বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হচ্ছে । অসুস্থ বন্দিকে হাতে-পায়ে শেকল দিয়ে কারা হাসপাতালে ফেলে রাখা হচ্ছে। কারাগারের শ্বাসরুদ্ধকর কক্ষে দিনরাত অবরুদ্ধ করে গরু-ছাগলের খাবার উপযোগী অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার দিয়ে অসুস্থ ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মৃত্যুর দায় এড়াতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বানোয়াট গল্প করছে। তবে কারা হেফাজতে মৃত্যু ও হত্যার দায় এড়াতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কারা কর্মকর্তারা। প্রতিটি মৃত্যু ও হত্যার জন্য তাদের একদিন বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে।