কার্যত বিরোধীদলহীন কোরাম সংকট পূর্ণ সংসদের বর্তমান হালচাল
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং সরকারের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ আশানুরূপ কার্যকর হয়নি। এ জন্য কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি চিহ্নিত করেছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় স্পিকারের বলিষ্ঠ ভূমিকার অভাব রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আইন প্রণয়ন, বাজেট ও স্থায়ী কমিটির একতরফা ক্ষমতার ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে। হাইব্রিড প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সংসদের কার্যক্রমে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সংসদের ২২ অধিবেশনে কোরাম সংকটের কারণে মোট ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
১১তম জাতীয় সংসদের ১ থেকে ২২তম অধিবেশনে (জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩) টিআইবির সর্বশেষ ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.
প্রতিবেদনে সমস্যা সমাধানে ১৩টি সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংসদীয় নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তা নিশ্চিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা, বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং অসংসদীয় ভাষা নিষিদ্ধে স্পিকারের ভূমিকা জোরদার করা।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী টিআইবির এসব তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, করোনার সময়ের বিবেচনায় এই সংসদ খুবই কার্যকর ছিল। বহু সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংসদ পরিচালনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, যারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন চায়, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে পাকিস্তানের ইমরান খানের সরকারকে এখানে ছুঁড়ে ফেলার মতো পরিস্থিতি তারা কি করতে চায়?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদীয় কার্যক্রমের মাত্র ১৬.৭ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়নে। ২০১৯-২০ সালে, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট তার সময়ের ৪৯.৩ শতাংশ আইন প্রণয়নে ব্যয় করেছে এবং ২০১৮ সালে ভারতের ১৭ তম লোকসভায় এটি ছিল ৪৫ শতাংশ।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি বিল পাস করতে গড় সময় লাগে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট। গত তিনটি সংসদে আইন প্রণয়ন ও বিল পাসের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। দশম সংসদে সময় ব্যয় হয়েছে ১২ শতাংশ আইন প্রণয়নে। এবং প্রতিটি বিল পাস হতে গড়ে ৩১ মিনিট সময় নেয়।
এতে বলা হয়, সংসদে পাস হওয়া বিলের ৫২ শতাংশ কোনো সংশোধনী পায়নি। সংশোধনী গ্রহণের ক্ষেত্রে শব্দের সন্নিবেশ এবং প্রতিস্থাপন প্রাধান্য পেয়েছে। বিলে প্রদত্ত নোটিশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের অতীত ইতিহাস, বিলের প্রয়োজনীয়তা, পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়া বিলের প্রস্তাবনা ইত্যাদি উল্লেখ করে উত্থাপিত প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর না দিয়ে খারিজ করা হয়েছে।
১২ টি বাজেট-সম্পর্কিত বিল বাদে মোট বিলের সংখ্যা ১০৮ টি ছিল। এর মধ্যে ৬৮টি নতুন বিল, ২৬টি সংশোধনী বিল এবং দুটি বাতিল বিল সংসদে পাস হয়েছে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে একটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৭০ মিনিট সময় লাগে, যার সর্বনিম্ন সময় প্রায় ২৮ মিনিট এবং সর্বাধিক সময় প্রায় ৩ ঘন্টা ২৫ মিনিট।
‘ভোটারদের তালিকা (সংশোধন) বিল-২০২০’ সবচেয়ে কম সময়ে পাস হয়েছে এবং যে বিলটি সবচেয়ে বেশি সময় নিয়েছে সেটি হল ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’।
টিআইবির তথ্যমতে, ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রশংসা করে এবং রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের বিতর্কে তাদের প্রায় ২০ শতাংশ সময় ব্যয় করেন। ১৯.৪ শতাংশ সময় ব্যয় করা হয়েছে সরকারের অর্জন নিয়ে কথা বলে। প্রায় ২৭ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতার পেছনে। প্রায় ২৬ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য ও আলোচনায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোরাম সংকটের কারণে মোট ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। অধিবেশনের শুরুর তুলনায় অবকাশের সময় বা তার পরে বেশি কোরাম সংকট লক্ষণীয় ছিল। সংসদের ২২টি অধিবেশনে মোট ৭৪৪ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় ব্যয় হয়। কোরাম সংকটের কারণে দৈনিক গড়ে ১৪ মিনিট ৮ সেকেন্ড নষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩৫০ জন। কমপক্ষে ৬০ জন সদস্যের উপস্থিতিতে সংসদের কোরাম পূর্ণ হয়। কোরাম পূরণ না হলে সংসদের বৈঠক হতে পারে না।
রিপোর্ট অনুযায়ী, গড় দৈনিক কোরাম সংকট ছিল ১৮মিনিট। তবে অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদের তুলনায় বর্তমান সংসদে কোরাম সংকট কমেছে। দশম সংসদে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকট ছিল। নবম সংসদে যা ছিল গড়ে ৩২ মিনিট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১২ জন স্ব-শিক্ষিত এবং একজনের শুধু স্বাক্ষর জ্ঞান রয়েছে। ৬২.৩ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী, মাত্র ১০.৯ শতাংশ রাজনীতিবিদ। অন্যান্য পেশার এমপিদের মধ্যে রয়েছে- ১১.৪ শতাংশ কৃষিবিদ, ৪ শতাংশ চিকিৎসক, ১৩.৭ শতাংশ আইনজীবী, ৩.৪ শতাংশ শিক্ষক। যদিও প্রথম সংসদে আইন পেশার এমপি ছিলেন ৩১ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী এমপি ছিলেন ১৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা আইনের (প্রধান প্রস্তাব) অধীনে সংসদে ২২টি নোটিশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই গ্রহণ করা হয়নি। নোটিশ দেওয়া এসব প্রস্তাবের বিষয়গুলো হলো- গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অনিয়ম-দুর্নীতি, সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপি নেতা-কর্মীদের মুক্তি, করোনা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা, নারী সমস্যা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রতি মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার কথা। তবে কোনো কমিটি এ নিয়ম মানেনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একাদশ সংসদে বিগত তিনটি সংসদের তুলনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর নয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ সংসদের কার্যকর ভূমিকার অন্তরায়। কার্যত বিরোধী দল না থাকায় সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এর চড়া মূল্য দিতে হয়। কারণ, এখন বাস্তবে সংসদ বিরোধী দলবিহীন। বিরোধী পরিচয়ে দলটি এখন আগের চেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে। যাইহোক, তারা সাধারণত স্ব-পরিচয়ের সংকটে ছিল। ফলে বিরোধী দলের প্রত্যাশিত ভূমিকা দেখা যায়নি।
তিনি বলেন, আগের সংসদের তুলনায় আইন প্রণয়নের (বিল পাস) গড় সময় বৃদ্ধি পেলেও সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও গঠনমূলক বিতর্কের অভাব ছিল। আইন প্রণয়নে সরকারি দলের অধিকাংশ সদস্যের অংশগ্রহণ বিলের পক্ষে ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরাবরের মতো, প্রস্তাবিত বাজেটে বিশ্লেষণ ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত ছিল। নাম পরিবর্তন করে অল্প সময়ের মধ্যে বাজেট ও অর্থ বিল পাস হয়য়ার।