২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে নিহতের সংখ্যা তথ্য:’অধিকার’ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের কারাদণ্ডঃ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত মানবাধিকার সংস্থার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান, ও পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের উচ্ছেদের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ অভিযোগে মামলাটি করা হয়।
একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম তার সর্বোচ্চ সাজা হবে। কিন্তু আদালত তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। আমরা রাষ্ট্রের পক্ষে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হতে পারিনি।”
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানের পর, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করে যে পুলিশের অভিযানে “অনেক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছে”। সরকারের বিরোধীরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রচারণা চালায়।
এরপর মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায় । এরপর মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করে তিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া, মিথ্যা তথ্য দেওয়া সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ।” সাজা বাড়াতে হাইকোর্টে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন আদিলুর রহমানের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, তিনি বলেন, মামলা হয়েছে ২০১৩ সালে এবং এর নথি দেখানো হচ্ছে ২০২৩ সালে। মামলা কিভাবে প্রমাণিত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজেত ইসলাম কর্মীদের উচ্ছেদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের প্রায় এক দশক পর বৃহস্পতিবার বিকেলে এই রায় ঘোষণা করা হয়।
রায় ঘোষণার সময় বিভিন্ন বিদেশি মানবাধিকার পর্যবেক্ষক আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেননি।
এর আগে গত ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ৭ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ধার্য করা হয়। তবে ওইদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় এর ঘোষণার তারিখ স্থগিত করে ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি মামলার বিচার শুরু হয়।
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের বিষয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ কারণে একই বছরের ১১ আগস্ট তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
এ সময় পুলিশ জানায়, মানবাধিকার সংগঠন অধিকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ৬১ জনের তালিকা মিথ্যা ও বিকৃত। সরকারের মতে, মৃতের সংখ্যা ১৩। সরকার তখন বলেছিল যে তারা অধিকারকে চিঠি দিয়ে ৬১ জন নিহতের নাম জানতে চেয়েছিল, কিন্তু অধিকার তথ্য দিতে অস্বীকার করে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক টুইটে বলেছে, “ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রধান আদিলুর রহমান খান ও এএসএম নাসির উদ্দিন এলানকে নিপীড়নমূলক আইসিটি আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।” এক দশকের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও অভিযোগের পর তাদের এই সাজা দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়েছে, “২০১৩ সালে একটি বিক্ষোভের সময় রাষ্ট্র কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নথিভুক্ত একটি তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশের পর মামলাটি দায়ের করা হয়।”
টুইটে আরও বলা হয়েছে, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথিভুক্ত করা কোনো অপরাধ নয়।আমরা বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে ইলানকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাই।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিস্টার খান ও এলানও পাশে থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন ,এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করছে।
অধিকারের সম্পাদক ও পরিচালকের সাজা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস।
এতে বলা হয়েছে, “ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আজকের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বিশ্বাস করে যে এটি মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের ভূমিকাকে আরও ক্ষুণ্ন করতে পারে।” ”
বিবৃতিতে আরও যোগ করা হয়েছে “আমরা গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে সমর্থন করে যাচ্ছি এবং মৌলিক অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছি,” ।
দ্য এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস, একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা, আদালতের মামলার রায়ের আগে আজ আদিলুর রহমান খান এবং নাসির উদ্দিন এলানকে সমর্থন করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা এই দুই মানবাধিকার কর্মীকে পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেন।
বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জনগণের মেলামেশার অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ তারা গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়। বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীদের মতো সংগঠনের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে কাজ করার জন্য এই স্বাধীনতা প্রয়োজন।বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরাও ।
আরও খবর
বিশ্বজুড়ে রেকর্ড সংখ্যক সাংবাদিক জেলবন্দি
বিখ্যাত গায়িকা লেডি গাগার কুকুর হত্যা, যুবকের ২১ বছরের জেল
আলফাডাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃতি,গ্রেফতার বিএনপি নেতাকর্মীরা
২০১৩ সালের আগস্টে আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের ঢাকা কার্যালয় পরিদর্শন করেন। এ সময় সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, কানাডাসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরাও তার সঙ্গে ছিলেন।
এ সময় অধিকার কর্মকর্তারা জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা সংগঠনটির সার্বিক অবস্থা এবং আদিলুর রহমান খানের খোঁজ খবর নিয়েছেন। একই সঙ্গে জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে অধিকার বিষয়ক সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের মুক্তি দাবি করেছে।