২০২৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯৬ জন গণপিটুনিতে ৭৩ জন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ৩৩ জন নিহত
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) অনুসারে, ২০২৩ সালে, রাজনৈতিক সহিংসতায় ৯৬ জন, ৭৩ জন গণপিটুনিতে এবং ৩৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন।
রবিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এইচআরএসএস বলেছে, ১২ টি জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআরএসএস-এর তথ্য গবেষণা ইউনিটের তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
একই সময়ে, বিদায়ী বছরে মুখোশধারী অ্যামবুসের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন ঘটনাও দেখা দিয়েছে। রাতে বা নির্জন রাস্তায় এসব ঘটছে। এর শিকার হচ্ছেন বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতারা।
এ ছাড়া বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, দাঙ্গা, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনুপস্থিত মামলা দায়ের এবং তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এসব মামলায় সাজা প্রদান।
এইচআরএসএস-এর মতে, এ বছর রাজনৈতিক সহিংসতার ৯৩৩ টি ঘটনায় ৯৬ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৯২৫৮ জন আহত হয়েছে। যার বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, নির্বাচনী সহিংসতা এবং বিএনপির মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের হামলা পাল্টা হামলা সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের ৮ হাজার ২৭৭ জনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৮ হাজার ৫৫৬ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৪৫৬ টি মামলায় কমপক্ষে ১৪৪০০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং একই সময়ে অজ্ঞাত আসামি হিসাবে ৫৮৯৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে ।
এইচআরএসএস-এর মতে, বিরোধী দলের অন্তত ৬২৮ টি বৈঠকে বা সমাবেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি দলের নেতারা বাধা দিয়েছিলেন। এদিকে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩ হাজার ৩৯১ জন আহত এবং সমাবেশে ৬ হাজার ৫০ জনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া নির্বাচনী সহিংসতার ২৫৬টি ঘটনায় ৯ জন নিহত ও অন্তত ১৪৩৯ জন আহত হয়েছেন। শুধুমাত্র ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচনী সহিংসতার ১৮৭টি ঘটনায় ৫ জন নিহত এবং অন্তত ৯০২ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর ১৯৪টি হামলায় ৩৬৭ সাংবাদিক নিহত, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২ সাংবাদিক নিহত এবং কমপক্ষে ১৮৬ জন আহত, ৮৬ জনকে লাঞ্ছিত করা হয়, ২৬ জনকে হুমকি দেওয়া হয়, ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৫৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একই সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা ৫৮টি মামলায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার ও ১৮৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ২৭টি হামলায় ৪৩ জন আহত হয়েছে এবং ১৭টি মন্দির, ৩১টি প্রতিমা ও ২৫টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাংচুর করা হয়েছে। মার্চ মাসে পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় ১ জন নিহত ও অন্তত ৬০ জন আহত হয়। এ হামলায় অন্তত ১০১টি বাড়ি ও ৩০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এইচআরএসএসের মতে, ‘গণপটুনির’ ১১৩ টি ঘটনায় ৭৩ জন নিহত ও ৮৮ জন আহত হয়েছে। এ সময় শ্রমিক নির্যাতনের ১৯৮টি মামলায় পুলিশের গুলিতে ৩ জনসহ ৪০ জন নিহত ও ৩৫০ জন আহত হয়েছেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবের কারণে দুর্ঘটনায় 148 জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৩১ টি ঘটনার শিকার ৩৩ জন। যাদের মধ্যে ৭ জন তথাকথিত ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, ৭ জনকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৮৪ জনের। শুধু ডিসেম্বরেই হেফাজতে ১৫ জন মারা যান, যার মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ৮ জন।
সংস্থাটির মতে, চলতি বছর জুড়ে দেশে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা রয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ব্যাহত, মিথ্যা মামলা, গণগ্রেফতার, রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেআইনি ও নৃশংস আচরণ দেশের মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সাংবাদিকরা হামলা, মামলা এবং গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হয়েছেন। সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে হত্যা-নির্যাতনসহ নানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এইচআরএসএস-এর পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার জন্য এবং দেশের সকল সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
গত এক বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানবাধিকারের সম্মান, সুরক্ষা ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। গত এক বছরে এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের নজর ছিল না। যখনই মানবাধিকারের কথা উঠেছে, তারা আত্মরক্ষামূলক কথা বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মানবাধিকারকে সম্মান করা হয়নি। মানবাধিকার সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের আচরণ দেখলে মনে হয়, তারা মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেই না।
সরকার মনে করে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট। তিনি বলেন, মানুষের মানসিকতা ও মানবাধিকার উন্নয়নের দায়িত্ব তাদের নেই।