ডেঙ্গু পরিস্থিতি রাজনৈতিক ব্যস্ততার ফাঁদে অবহেলিতঃ প্রকোপ মৃত্যু ও আক্রান্ত চলছেই
ডেঙ্গু জ্বরঃ
ডেঙ্গু জ্বর ; ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ হলেও এখন দীর্ঘ মশা তার চরিত্রকে বহুরূপে রূপায়িত করে সকল ঋতুতেই আক্রমণ করতে পারে এবং ভাইরাস ছড়াতে পারে। , যা এডিস মশা দ্বারা বাহিত হয়। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ সাধারণত এডিস মশার কামড়ে ভাইরাস ছড়ানোর তিন থেকে পনের দিনের মধ্যে দেখা যায়। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা এবং ত্বকে ফুসকুড়ি। ডেঙ্গু রোগী সাধারণত দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সেরে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে, এই রোগটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর নামে একটি গুরুতর হেমোরেজিক রূপ নিতে পারে। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্তের প্লেটলেটের মাত্রা কমে যায় এবং রক্তের প্লাজমা নিঃসৃত হয়। কখনও কখনও কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্ত প্রবাহ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা যখন কাউকে কামড়ায় তখন মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি ত্বকে প্রবেশ করে। এটিপাকাপোক্তভাবে বাসা বাধে এবং শ্বেত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে এবং ভাইরাসটি কোষের ভিতরে প্রজননকার্য চালিয়ে যায় । তখন সেই ভাইরাস সারা শরীর জুড়ে বিচরণ করে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুকেও যেন কেউ আমলে নিচ্ছে না । তবে হ্যাঁ যারা আক্রান্ত হয়েছে ,যারা হারিয়েছে তাদের প্রিয়জন , তাদের বেদনা যদি পরিমাপ করা যেত তাহলে হয়তো বা প্রতিটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এই বিশেষ এবং খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতো । কিন্তু ক্ষমতার উচ্চ মাকামে পৌঁছার স্বাদ যেন সবিই শেষ করে দিচ্ছে। থোরাই কেয়ার করা হচ্ছে না ডেঙ্গুর এই দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহতাকে।
এই বছরের শুরু থেকে, বাংলাদেশ ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, আক্রান্ত মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই; ২০২৩ সালের মধ্যে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ পরিসংখ্যান দেখে তারা বলছেন, এইডস মশাবাহিত রোগের প্রকোপ ও মৃত্যু কিছুটা কমেছে। চলতি মাসের নভেম্বরের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকবে। তবে শীত শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্কতার কথাও মনে করিয়ে দেন তারা । বিশেষজ্ঞরা বলছেন “সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চরমে ওঠে। তাই এখনো আরাম করার সুযোগ নেই। নভেম্বরের শেষ নাগাদ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে বলে তারা আশাবাদী।
বছর শেষ হতে দেড় মাসেরও বেশি সময় বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী ও মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মোট দুই লাখ ৭৭ হাজার ৮০১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এর মধ্যে ১ লাখ ৭১৭ জন ঢাকার বাসিন্দা এবং ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪ জন ঢাকার বাইরে রয়েছেন। একই সময়ে,২৬৯,৭৭২ জন ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯৮ হাজার ৫৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭১৮ জন। সারাদেশে ডেঙ্গুতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৩৯৩। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী। অন্যদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৬ হাজার ৬৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।
পূর্ববর্তী পাঁচ বছরে, শুধুমাত্র ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এক লাখ ডেঙ্গু রোগী দেখেছিল; অন্য কোনো বছর এত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখেনি। তিন বছর পর ২০২২ সালে, দেশে এই ভাইরাসের কারণে ২৮১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, যেই সংখ্যার চারগুণ মৃত্যু গত ১০ মাসেই দেখেছে বাংলাদেশ।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মশাবাহিত বিভিন্ন রোগে বিশ্বে প্রতি বছর সাত লাখ মানুষ মারা যায়।১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগ আসে। কিন্তু ২০১৯ সালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। “সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল এই বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।” স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাস থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এরপর মৃত্যুর হারের পাশাপাশি বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা। অনেক পরিবার প্রিয়জন ও নির্ভরশীলদের হারিয়েছে। রোগে আক্রান্ত হয়েও অনেক কষ্ট পেয়েছেন।
সারা বছর ডেঙ্গু?: স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. আহমদুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গুর তীব্রতা কমবে। তখন তাপমাত্রাও যেমন কমবে, মশাও কমবে; ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে।” তবে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ইতিমধ্যে বিদায় নেওয়ায় বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ। তিনি বলেন, “বর্ষার হাওয়া চলে গেছে। তাই এখন স্বাভাবিক, মানে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশে এক সময় বর্ষাকালকে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হলেও; আহমেদুল কবির মনে করেন, বাস্তবতা এখন বদলে গেছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এখন পিক সিজন বলে কিছু নেই। সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গু রোগী পাবেন। আমাদের পরামর্শ এখনও মশা নিয়ন্ত্রণসহ প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থা নিতে হবে। সারা বছরই কাজ করতে হবে। নেই। শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা।”
ডক্টর আহমদুলের বক্তব্য এ বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিল রয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে বছরের সব সময়েই কমবেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত বা মৃত্যু ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু সারা বছরব্যাপী রোগে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু এখন ঢাকা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে; নগরায়নের ফলে গ্রামগুলোও মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। এ অবস্থা মোকাবেলার প্রশ্নে তিনি বলেন, এইডস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে; যাতে ‘সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা’র বিষয়টিও থাকে।
1 Comment