ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর পর চলে গেলেন মা আঁখিওঃ সেন্ট্রাল হাসপাতালের সমস্ত অপারেশন স্থগিত: স্বাস্থ্য বিভাগ
ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মৃত্যুঝুঁকিতে পড়া মাহবুবা রহমান আঁখি মারা গেছেন। রোববার (১৮ জুন) দুপুর পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসাপাতালে মারা যান তিনি।
দুপুর সোয়া ২টার দিকে এ তথ্য জানান আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা বলেছেন সে মারা গেছে। আসলে আমার সবকিছুই জেনো শেষ।
গত বুধবার (১৪ জুন) সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখি নামের এক প্রসূতি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন বলে অভিযোগ করেন তার স্বামী ইয়াকুব আলী। তিনি দাবি করেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা গেছেন তাদের নবজাতক সন্তান।
সরেজমিনে খবর নিয়ে জানা যায় যে, রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অপারেশন (সার্জারি) বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পাশাপাশি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহাকে আপাতত হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমের বাইরে রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে শুক্রবার (১৬ জুন) এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সাত দফা নির্দেশনা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বুধবার (১৪ জুন) মাহবুবা রহমান আঁখি নামে এক গর্ভবতী নারী কর্তৃপক্ষের ‘ভুল চিকিৎসা’ ও ‘প্রতারণার’ কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বামী ইয়াকুব আলী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তাদের নবজাতক শিশুরও মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
জানা যায়, গত তিন মাস ধরে মাহবুবা রহমান আঁখি কেন্দ্রীয় হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা ‘স্বাভাবিক’ বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসক। স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান প্রসব সম্ভব বলেও আশ্বস্ত করেন ডা.সংযুক্তা সাহা।
৯ জুন, দুপুর ১২.৫০ মিনিটে প্রসব বেদনার কারণে সেন্ট্রাল হাসপাতালে মাহবুবকে ভর্তি করা হয়। সে সময় ডা. সংযুক্তা সাহা দেশে না থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের জানায় যে ডা. সংযুক্তা সাহা ওটি (অপারেশন থিয়েটার) তে কর্মরত ছিলেন। যখন অন্য ডাক্তারদের দ্বারা প্রাকৃতিক প্রসবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুটিকে বের করা হয়। পরের দিন শিশুটি মারা যায়।
প্রসূতি মাহবুবা রহমান আঁখির অবস্থাও ভালো নয়। তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে অচেতন। ওই ঘটনায় বুধবার ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলায় মৃত্যুর’ অভিযোগে পাঁচ থেকে ছয়জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মোট ছয়জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এতে ছয়জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ডাঃ শাহজাদী মুস্তারশিদা সুলতানা ও ডাঃ মুনা সাহাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা হলেন ডাঃ মিলি, ডাঃ এহসান, সহকারী অধ্যাপক জমির ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপক পারভেজ।
মামলায় গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসক ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহা ইতোমধ্যে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। তারা স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তা রেকর্ড করার অনুরোধ করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম ফারহা দিবা চন্দ আসামি মুনার ও ঢাকা মহানগর হাকিম আফনান সুমি আসামি শাহজাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
এদিকে চিকিৎসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি পরিদর্শন দল হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনে রোগীকে আইসিইউতে রাখার উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়া যায়নি। এ কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাসপাতালের সার্জারি রুম বন্ধ রাখাসহ একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া কিছু নির্দেশিকাগুলির মধ্যে রয়েছে-
১.স্বাস্থ্য বিভাগের লিখিত অনুমোদন ব্যতিরেকে কোন বিশেষজ্ঞ সেন্ট্রাল হাসপাতালে সেবা প্রদান করতে পারবেন না।
২. আইসিইউ এবং জরুরি পরিষেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটার বন্ধ থাকবে।
৩. মাহবুবা রহমান আঁখির পরিবার থেকে প্রাপ্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতা সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ কেন্দ্রীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
৪. রোগীর চিকিত্সার সাথে জড়িত সমস্ত ডাক্তার এবং সমস্ত মেডিকেল নথি বিএমডিসিতে পাঠাতে হবে। বিএমডিসি থেকে চিকিৎসকের নিবন্ধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পেলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
৫.শিকার যদি কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করে, বিদ্যমান আইনি প্রক্রিয়া অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।
৬. চলমান আদালতে মামলার আসামি ড. শাহজাদী ও ডা. মুনার যাবতীয় খরচ কেন্দ্রীয় হাসপাতাল বহন করবে।
৭.অভিযোগ সংক্রান্ত সমস্ত নথি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগে পাঠাতে হবে৷ ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভাগটি বলেছে যে নির্দেশাবলী শুক্রবার (১৬ জুন-২০২৩) থেকে কার্যকর হবে এবং কোনও লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
1 Comment