জেলেনস্কি-ট্রাম্প বাকবিতণ্ডা, ট্রাম্প জেলেনস্কিকে দুপুরের খাবার না খেয়েই বললেন বের হয়ে যেতে
শুক্রবার রাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে মৌখিক বাকবিতণ্ডা হয়। সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনেই এই অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। মৌখিক বাকবিতণ্ডার বিষয়টি মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে যে, ট্রাম্প জেলেনস্কিকে দুপুরের খাবার না খেয়েই হোয়াইট হাউস ছেড়ে যেতে বলেছিলেন।
একজন ইউএস কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসের ভেতরে “বিতর্ক” হওয়ার পর ট্রাম্প তার মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি পৃথক কক্ষে যান। অন্যদিকে, জেলেনস্কি তার প্রতিনিধিকে নিয়ে অন্য কক্ষে যান। যা সাধারণত একজন রাষ্ট্রীয় অতিথি আসার সময় করা হয়। তারপর, একটি পৃথক কক্ষে গিয়ে ট্রাম্প তার মন্ত্রীদের কাছে উল্লেখ করেন যে, জেলেনস্কির কথার ভাষায় তিনি অসম্মানিত বোধ করছেন। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে জেলেনস্কি শান্তি চান না। তারপর তিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় দলকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস ছেড়ে যেতে বলেন।
তবে, ইউক্রেনীয়রা তখনও আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের অনুরোধ গৃহীত হয়নি। শেষ পর্যন্ত জেলেনস্কিকে চলে যেতে হয়।
সিএনএন জানিয়েছে যে, জেলেনস্কি এবং তার দলের জন্য তৈরি খাবার, যেমন সালাদ, মুরগি এবং ক্রিমি বার্লি, সেখানেই রেখে পরে আছে। জেলেনস্কি এবং তার দল হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবারও খেতে পারেননি। ট্রাম্প তাদের সরাসরি তার আগেই চলে যেতে বলেছিলেন।
তর্ক-বিতর্ক শুরু করেছিলেন মূলত ইউএস ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তিনি জেলেনস্কিকে বলেছিলেন যে, তার উচিত যুক্তরাষ্ট্র এবং ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানানো। কারণ তারা গত তিন বছর ধরে তাদের সাহায্য করে আসছে। তিনি কূটনীতির মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ শেষ করার কথাও বলেছিলেন। সেই সময় জেলেনস্কি জিজ্ঞাসা করেন যে,, তিনি কোন কূটনীতির কথা বলছেন? কারণ এরআগেও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। এরপরই একেঅপরে উত্তপ্ত হয়ে যান। তখনই হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আগে জেলেনস্কিকে চলে যেতে বলা হয়।
হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একটি বৈঠক উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্কে পরিণত হয়। সেই সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়া উপস্থিত ছিল। শুক্রবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাশিয়ার সাথে চলমান যুদ্ধের প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থন বজায় রাখার চেষ্টা করছিলেন জেলেনস্কি, কিন্তু বৈঠকের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
জেলেনস্কি ওভাল অফিসের এই বৈঠককে রাশিয়ার পক্ষ না নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। পুতিন তিন বছর আগে ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তা ব্যর্থ হয়, তখন জেলেনস্কি তার সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন।
ট্রাম্প এবং জেডি ভ্যান্স জেলেনস্কির প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করেছেন। এতে ইউক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকালীন মিত্রের সাথে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, “জেলেনস্কিকে বৈঠক ত্যাগ করতে বলা হয়েছিল।”
ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদের উন্নয়নের বিষয়ে একটি যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিয়েভ এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা চুক্তিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি এবং এর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
হোয়াইট হাউসের ঘটনার পর ইউরোপীয় নেতারা দ্রুত জেলেনস্কির সমর্থনে এগিয়ে আসেন।এই প্রেক্ষিতে জার্মান চ্যান্সেলরের প্রার্থী ফ্রিডরিখ মের্জ বলেছেন “এই ভয়াবহ যুদ্ধে, আক্রমণকারী এবং ভুক্তভোগীকে কখনও বিভ্রান্ত করা উচিত নয়,” । এব্যাপারে জেলেনস্কি ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন, ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি আন্তোনিও কস্তার সাথে ফোনে কথা বলেছেন।
এদিকে, ব্রিটেন রবিবার ইউরোপীয় নেতাদের সাথে জেলেনস্কির একটি বৈঠক আয়োজন করবে যাতে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখিয়েছেন, যা ইউরোপ সহ ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের অবাক করেছে এবং ইউক্রেনকে আরও দুর্বল করেছে। শুক্রবারের ঘটনাটি তার অবস্থান পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রকাশ্য উদাহরণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলার পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর পর এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। জেলেনস্কি যুক্তি এড়িয়ে যান, বলেন যে, পুতিনকে বিশ্বাস করা যায় না এবং ভ্যান্স কখনও ইউক্রেন সফর করেননি।
সেই সময় জেলেনস্কি বলেন, “আপনি কোন কূটনীতির কথা বলছেন , জেডি?” জবাবে ইউএস ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি এমন একটি কূটনীতির কথা বলছি যা আপনার দেশের ধ্বংস থামাতে পারে।”
জেলেনস্কি সরাসরি ট্রাম্পের রাশিয়াপন্থী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, “একজন খুনির সাথে আপস করবোনা।”
এবং বৈঠকের পরপরই ট্রাম্প জেলেনস্কির বিরুদ্ধে ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করেন। তিনি লিখেছেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমেরিকা জড়িত থাকলে রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নাও হতে পারেন। তাই যখন তিনি শান্তির জন্য প্রস্তুত হতে পারেন, তখন তিনি আসতে পারেন।”
২০২২ সালে ইউক্রেন কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয় এবং বিশাল এলাকা পুনরুদ্ধার করে, কিন্তু রাশিয়া এখনও তার ভূখণ্ডের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দখল করে আছে এবং ২০২৩ সালে ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণের পর থেকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। ট্রাম্প সম্প্রতি জেলেনস্কির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মন্তব্য করেছেন, তাকে “একনায়ক” বলে অভিহিত করেছেন এবং খনিজ অধিকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বলেছেন, যদিও পরে তিনি “একনায়ক” মন্তব্যটি সংশোধন করেছেন।