রক্তে দ্রুত হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর উপায়
হিমোগ্লোবিন বাড়ায় এমন খাবার রয়েছে আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে । রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে খাবার বিশেষ করে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার বিকল্প নেই। ভিটামিন বা আয়রন জাতীয় ওষুধ না খেয়ে খাবার খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানো যায় সহজে এবং নিরাপদে। ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, কিন্তু প্রাকৃতিক খাবারের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
স্তন্যপায়ী রক্তকণিকাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা:
লোহিত রক্তকণিকা – এরিথ্রোসাইট
শ্বেত রক্তকণিকা – লিউকোসাইট
অণুচক্রিকা- {platelet}– থ্রম্বোসাইট
এর মধ্যে রয়েছে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিন (লাল রক্ত কণিকার প্রধান উপাদান), এক ধরনের আয়রন-যুক্ত প্রোটিন যা টিস্যু থেকে ফুসফুসে অক্সিজেন এবং ফুসফুস থেকে টিস্যুতে কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন করে। যেখানে একটি বিশেষ আয়রন যৌগ থাকে, যাকে চিকিৎসার ভাষায় হিমোগ্লোবিন বলে।
রক্ত মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রক্ত শরীরের জ্বালানী। রক্ত শরীরের সমস্ত অংশে অক্সিজেন এবং পুষ্টি বহন করে। শরীরে রক্তের কোনো উপাদান কম থাকলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
রক্ত হল এক ধরনের কোষ, যা অনেক জৈব এবং অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। একটি সামান্য নোনতা, আঠালো, ক্ষারীয় এবং লাল পুরু তরল যা নিয়মিতভাবে হৃৎপিণ্ড, ধমনী, শিরা এবং কৈশিক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মানুষের শরীরের ৮% রক্ত। অর্থাৎ মানুষের শরীরে গড়ে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে।
শরীর তত্ত্বের পরিভাষায় রক্তশূন্যতার সমস্যাকে অ্যানিমিয়া বলা হয়। রক্তে লোহিত কণিকা বা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে প্রধানত এই রোগটি হয়। হিমোগ্লোবিন হল এক ধরনের প্রোটিন যা লোহিত রক্তকণিকায় পাওয়া যায় যাতে আয়রন এবং অক্সিজেন থাকে। যদিও এটি ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়, তবে পুরুষদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকার স্বাভাবিক পরিমাণ ১৩.৮ থেকে ১৭.২ ডেসিলিটার। মহিলাদের জন্য ১২.১ থেকে ১৫.১ ডেসিলিটার।
ক্লান্তি বা দুর্বলতা অ্যানিমিয়ার সাধারণ লক্ষণ। অন্যান্য উপসর্গ হল শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, হাত-পা ঠান্ডা হওয়া। এ ছাড়া ফ্যাকাশে ত্বক, বুকে ব্যথাও রক্তস্বল্পতার অন্যতম লক্ষণ। এগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।। রক্তশূন্যতা থেকে বাঁচার উপায় হল এমন কিছু খাবার খাওয়া যা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। এখানে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হল যা নিয়মিত খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়বে।
কালো কচু শাক
প্রাকৃতিকভাবে রক্ত উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস হলো কালো কচু শাক । কালো কচু শাকে রক্তের আইটেমের সকল ধরনের খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোহিত রক্ত কণিকার উপাদান বা হিমোগ্লোবিনের উপাদান রয়েছে। কালো কচুশাকে শতকরা ৩৪ থেকে ৩৬ পার্সেন্ট পর্যন্ত রক্ত থাকে । তাই কালো কচু শাক যেকোনো পদ্ধতিতে হোক রান্না করে খাওয়া যায়।
শিং মাছ
শিং মাছ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং রক্তের সমাহার। লোহিত রক্ত কণিকা বা হিমোগ্লোবিন বাড়াতে নিয়মিত শিং মাছ খেতে পারেন ।
বরবটি
বরবটি লোহিত রক্ত কণিকার উপাদানের অন্যতম একটি সবজি। এসব যে বেশি বেশি খেতে পারেন । তাহলে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ অবশ্যই বেড়ে যাবে । হিমোগ্লোবিন বেড়ে যাবে , অ্যানিমিয়া থেকে মুক্ত পাবেন এবং মুখের রুচিও বাড়াবে।
মাংস
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দ্রুত বাড়াতে পর্যাপ্ত প্রাণিজ প্রোটিন প্রয়োজন। সব ধরনের লাল মাংস; উদাহরণস্বরূপ, আয়রনের সেরা উত্সগুলির মধ্যে রয়েছে গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস এবং কলিজা । হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য আয়রন অপরিহার্য। যদিও মুরগির মাংস লাল মাংস নয়, তবে এটি শরীরকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন সরবরাহ করতে পারে।
ডিম
ডিম হল আরেকটি জনপ্রিয় খাবার যাতে উচ্চ আয়রন এবং অন্যান্য পুষ্টি থাকে। ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল ও ভিটামিন থাকে। আর এ কারণেই দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতিদিন সেদ্ধ ডিম খেতে বলা হয়।
শস্য খাদ্য
চাল, গম, বার্লি এবং ওটস রক্তশূন্য রোগীদের জন্য চমৎকার আয়রন সমৃদ্ধ খাবার। এই খাবারগুলি প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেটও সরবরাহ করে। লাল চালকে লোহার সমৃদ্ধ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশেষ করে সব বয়সের মানুষের জন্য।
শাকসবজি
শাকসবজি খেলে আয়রনের ঘাটতি দূর হয়। বীটের মতো দানা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। টমেটো, কুমড়া, ব্রকলি বা পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। এগুলো খেলে রক্তস্বল্পতার সমস্যাও কমতে পারে।
সীফুড
সামুদ্রিক খাবার আয়রন এবং অন্যান্য খনিজ পুষ্টি সমৃদ্ধ। অতএব, রক্তাল্পতা রোগীদের তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ঝিনুক, ক্লাম এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক খাবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
নেটেল চা পান
এটি নেটল গাছের পাতা থেকে তৈরি একটি চা, যা আসলে আয়রনের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে , আপনি এই পানীয়টিতে আয়রন এবং ভিটামিন সি পাবেন। স্বাদ সবজির ঝোলের মতোই।
মাছ
কিছু মাছ আয়রন সমৃদ্ধ। রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা পছন্দের কিছু মাছ খেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তুলা, কাতলা, ইলিশ, পোমফ্রেট খাওয়া যেতে পারে।
শুষ্ক ফল
হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে শুকনো ফল খেতে পারেন। কিসমিস, কাজু, খেজুর প্রচুর পরিমাণে আয়রন। এপ্রিকটও প্রচুর আয়রন সমৃদ্ধ। খেজুর শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে।
বীট
শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ বাড়াতে বীটের জুড়ি মেলা ভার। ডায়াবেটিস রোগীদের বিট এড়ানো উচিত, কারণ বিটে চিনির পরিমাণ বেশি। বিট পাতায় বীটের চেয়ে বেশি আয়রন থাকে। তাই এই পাতা খেতে পারলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
পেস্তা
রোজ সকালে তিন থেকে চারটি পেস্তা খেতে পারলে খুব ভালো। পেস্তা খেলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। এই ফলটিতে ৩০ ধরনের ভিটামিন রয়েছে। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে।
ডুমুর
ডুমুরে রয়েছে ভিটামিন এ, বি১, বি২, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরিন। প্রতিদিন রাতে দুটি ডুমুর পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং পরদিন সকালে ছেঁকে নিন। এতে হিমোগ্লোবিনও বাড়বে। ডুমুর দিয়ে সুস্বাদ তরকারিও বানাতে পারেন।
বেদানা বা ডালিম
বেদানায়, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়াও প্রচুর আয়রন রয়েছে। এক গ্লাস দই দুধের সাথে বাদামের গুড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন । এতে শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়বে।
কিসমিস
কিসমিস রক্ত গঠনে ভূমিকা রাখে। কিশমিশে রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। বিশেষ করে কালো কিশমিশে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। তাই নিয়মিত কিশমিশ খান, ভালো কাজ করবে।
তিল
তিলের বীজ আয়রন, কপার, ফোলেট, ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। এই উপাদানগুলো রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
কালো চকলেট
হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি কমাতে ডার্ক চকলেটের দারুণ দাবি রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে দুধের চকোলেট খাওয়া রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে। কিন্তু ডার্ক চকোলেটের সেই সমস্যা নেই। বরং এটি খেলে আয়রনের ঘাটতি অনেকটাই কমবে।
ভিটামিন সি
শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি না থাকলে আয়রন শরীর ঠিকমতো শোষণ করতে পারে না। তাই এমন ফল নিয়মিত খাওয়া উচিত, যাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। আম, লেবু, আপেল, পেয়ারার মতো ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। ভিটামিন সি শরীরকে অন্যান্য খাবার থেকে আয়রন পেতে সাহায্য করে।
এই সব খাবার শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে দ্রুত রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। তাই নিয়মিত এসব খাবার খেলে শরীরে রক্তের পরিমাণ, জীবনীশক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে থাকুন।
আরও জানুন
রাগ মোকাবেলার কিছু ফলপ্রসূ স্বাস্থ্যকর উপায়
সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সাড়ে ৬ লাখ সিগারেট ফিল্টার সংগ্রহ করেছেন পরিবেশকর্মীরা