দেনমোহর বা মোহরানা নারীর অধিকার
ইসলামে, মোহর বা মোহরানা (আরবি: محر ) হল বিয়ের সময় কনে কর্তৃক দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বর পক্ষ কর্তৃক কনেকে প্রদান করতে হয়।এটা ওয়াজিব। মোহরানার মাধ্যমে বিবাহ সম্পূর্ণরূপে বৈধ হয়। প্রাচীন আরবে যৌতুক দেওয়ার প্রথা তখনও প্রচলিত ছিল, নবুওয়াত পাওয়ার পর মুহাম্মদ (স.)যৌতুক প্রথা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেন এবং বাধ্যতামূলক মোহরানা চালু করেন। ইসলামে মোহরানার কোনো সীমারেখা নেই। যা বরের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়।মোহরানা হলো বিয়ের মূল্য, যা কেবল কনের অবশ্য প্রাপ্য। এটি কখেনো বরের বা অন্য কারো প্রাপ্য হয় না।
দেনমোহর হল কিছু অর্থ বা অন্যান্য সম্পত্তি যা একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে বিবাহের বন্দোবস্ত হিসাবে পাওয়ার অধিকারী। দেনমোহর স্ত্রীর সম্মানের প্রতীক। দেনমোহর হল স্বামীর উপর স্ত্রীর সম্মানের চিহ্ন হিসাবে আরোপিত একটি কর্তব্য। দেনমোহর স্ত্রীর একক অধিকার এবং স্বামীর পক্ষ থেকে বিয়েতে স্ত্রী তার মর্যাদা ও যোগ্যতা অনুযায়ী দেনমোহর অধিকারী।
দেনমোহর নির্ধারণের পদ্ধতি- ইসলামে দেনমোহর পরিমাণ নির্ধারিত নেই। তাই এটা আপেক্ষিক। অর্থাৎ বর ও কনে উভয়কেই বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা হয়। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণের সময় স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্য যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, এদের জন্য দেনমোহরের পরিমাণ বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হয় স্ত্রীর পিতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বংশের অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে। অন্যদিকে, বরের আর্থিক সক্ষমতার দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়। এসব দিক বিবেচনা করেই মূলত দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়।
মানবতার ধর্ম ইসলাম সুন্দর ও পবিত্র জীবন যাপনের জন্য একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছে। কোরানে উল্লেখ আছে, ‘তোমাদের পছন্দের নারীকে বিয়ে কর, দুই-তিন- বা চারটি; কিন্তু যদি ভয় পাও যে তুমি ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে পারবেন না, তবে শুধুমাত্র একটি বিয়েই কর।’ (সূরা নিসা, আয়াত, ৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের কিতাবপ্রাপ্ত মুমিন নারী ও সতীত্বশীল নারীদেরকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে, যদি তোমরা তাদের বিয়ের জন্য মোহরানা দাও, তারা প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গোপন প্রেমিক গ্রহণের মতো নয়। -(সূরা মায়েদা, আয়াত, ৫)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিবাহ আমার সুন্নত, যে আমার সুন্নত অনুযায়ী আমল করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়। তুমি বিয়ে করো কারণ হাশরের ময়দানে উম্মতের সংখ্যা নিয়ে আমি গর্বিত হব।’ (ইবনে মাজাহ)
আরও পড়তে পারেন
পরিবারের সদস্যদের আনন্দ দেওয়া মহানবীর সুন্নত
মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ উদ্বোধন
আখেরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসঃ গুরুত্বপূর্ণ কয়টি বিষয়
ইসলামী আইন অনুযায়ী কোন নারীকে বিয়ে করার সময় তাকে বিয়ে কর দিতে হবে। যৌতুক আরোপ একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থ (সম্পদ) দান কর, তবে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করো না…” (সূরা) : আন-নিসা, আয়াত: ২০)
দেনমোহর ন্যূনতম পরিমাণঃ
এই আয়াত থেকে জানা যায় যে, কেউ চাইলে তার স্ত্রীকে মোটা অংকের যৌতুক দিতে পারে। কোরআনের অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “ধনীরা তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার সীমিত সম্পদ আছে সে আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করবে…” (সূরা: তালাক, আয়াত: ৭)
সে যেন তার ন্যায্য অধিকার পায় এবং নারীর অবমূল্যায়ন না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়া যৌতুক নির্ধারণের সময় স্বামীর আর্থিক অবস্থাও বিবেচনায় রাখতে হবে। স্বামীকে তার সাধ্যের বাইরে চার্জ করা এবং তাকে আল্লাহের সামনে দাঁড় করানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
নারীকে প্রতারিত করা যাবে নাঃ
কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো নারীকে প্রতারিত করা যাবে না। স্ত্রীর বংশ এবং অনুরূপ কন্যাদের দেনমোহর দেয়কে বিবেচনায় রেখে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত। শরীয়ত মোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করেনি।
কেউ সামর্থ্য থাকলে যত খুশি দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করতে পারে। উম্মে হাবিবা (রাঃ) ব্যতীত, নবী (সাঃ) এর অন্যান্য স্ত্রীদের এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ)ছিল ৫০০ দিরহাম, যা প্রচলিত হিসাব অনুসারে ১৩১.২৫ ভরি খাঁটি রূপা বা এর সমতুল্য বাজার মূল্য।
যেহেতু পরিমাণ নিয়ে শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সামান্য মতভেদ নেই, তাই সতর্কতামূলক পূর্ণভাবে ভাল কিছুই গ্রহণ করা উত্তম।
উম্মে হাবিবা (রা.) এর মোহরটি আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ থেকে ৪০০ দিনারের জন্য সংগ্রহ করেছিলেন, যা আজকের হিসাবে ১৫০ ভরি খাঁটি সোনা, অন্যান্য হিসাবে ৪০০ দিরহাম রূপা। (মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা)
দেনমহরের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দঃ
শুধু টাকা দিয়েই মোহর দিতে হবে তা না। গয়না, গাড়ি, বাড়ি, জমি, বইও দিয়েও দেয়া যায়। কিন্তু স্ত্রী যদি ঐ জিনিসটিকে দেনমহর হিসেবে গ্রহণ করতে না চায়, তাহলে সে তা ফেরত দিতে পারে। যেমন: কেউ তার স্ত্রীকে মোহর হিসেবে একটি দামি ঘড়ি উপহার দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু যদি স্ত্রী এটি পছন্দ না করে বা এই মুহূর্তে এটির প্রয়োজন না হয় তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখেন।
বিয়ের পরেও দেনমহর দিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে সহবাসের আগে দেওয়া উত্তম। তবে স্ত্রী যদি যৌতুক না দিয়ে সহবাসের অনুমতি দেয় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। অবশিষ্ট স্ত্রী যৌতুক পরিশোধ না করে প্রথম সহবাসের পূর্বে বাঁধা দেয় তাহলে দেনমহর পরিশোধ করে যেতে হবে । কিন্তু একবার সহবাস অনুমতি দিলে স্ত্রী তা বন্ধ করতে পারবেন না। কিন্তু স্বামী কর্তৃক দেনমহর আদায় না হলে তা ঋণ হিসেবেই থেকে যাবে।
স্ত্রী যদি উক্ত দেনমহর মাফ না করে এবং স্বামী তা পরিশোধ না করে তাহলে কিয়ামতের ময়দানে স্বামী দোষী সাব্যস্ত হবে। তাই দেনমহরের টাকা পরিশোধ করা জরুরি।
আর স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমহর সানন্দে দাও। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সূরা নিসা,আয়াত -৪)
তোমাদের জন্যে হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর। (সূরা মায়িদা, আয়াত – ৫)
অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা গ্রহণ করবে,তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। (সূরা নিসা,আয়াত – ২৪)
তোমরা, এই নারীদেরকে প্রাপ্য মোহরানা দিয়ে বিবাহ করলে তোমাদের অপরাধ হবে না। (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত – ১০)
পরিশেষে বলা যায় , মোহরানা হচ্ছে কনের প্রাপ্য অধিকার। কনের বাবা কিংবা অন্য কারো জন্য এটি গ্রহণ করা জায়েয নয়; যদি না কনে সন্তুষ্ট চিত্তে তাদেরকে প্রদান না করে।
1 Comment