জেনে নেই রমজানের রোজা যেভাবে ফরজ হয়
রমজানে রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানরা আইয়ামে বিয ও আশুরাতে রোজা রাখতেন। কিন্তু তা তাদের উপর ওয়াজিব ছিল না, বরং সুন্নত ছিল। আইয়্যামে, বিয বা প্রতি মাসের মাঝের তিন দিনের রোজা (অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা) প্রাক-ইসলামী যুগের প্রকৃতি অনুসারে পালন করা হত।
মদীনায় হিজরতের পর ইহুদিদের আশুরার রোজা পালন করতে দেখে মুসলমানরা তাদের চেয়ে মহররম মাসে একদিন বেশি রোজা রাখতে শুরু করে। কিন্তু এগুলো ছিল ঐচ্ছিক, রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না।
মুসলমানদের অন্তরে যখন ইসলামী আকীদা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছিল, তখন নিয়মিত নামাজের মাধ্যমে তা ভালোবাসা বৃদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাদের মধ্যে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মতো মন ও মানসিকতাও তৈরি হয়েছিল। যেন মনে হলো- সব হুকুমের অপেক্ষার পর আল্লাহ রোজার আদেশ নাজিল করলেন।
হিজরীর দ্বিতীয় বছরে এটি ঘটেছিল। অর্থাৎ নবুওয়াতের ১৫ তম বছরে রোযার বিধান নাযিল হয়। প্রথমে এই আয়াত নাযিল হয়- হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)
কিন্তু প্রথমে মাসব্যাপী রোজা ফরজ ছিল না। বরং কয়েকদিন রোজা ফরজ ছিল, যাতে কঠিন মনে না হয়।
আর সেজন্য নাযিল হলো- গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে। যে-ব্যক্তি খুশীর সঙ্গে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখো, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পারো। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪)
কিন্তু বাধ্যতামূলক হলেও এর পরিবর্তে দরিদ্রদের খাওয়ানোর স্বাধীনতা ছিল।
শরীয়াহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ইসলামের শুরুতে, মুসলমানদের রোজা এবং ফিদিয়ার মধ্যে বেছে নেওয়ার বিকল্প দেওয়া হয়েছিল। তারা এ ব্যাপারে স্বাধীন ছিল। যেমন মাআয ইবনে জাবাল রা. তিনি বলেন, শুরুতে যারা ইচ্ছা রোজা রাখতো, যার ইচ্ছা না রেখে মিসকিনকে খাদ্য দান করত; কিন্তু পরে এই সুযোগ বাতিল করা হয়।
অতঃপর রমজানে রোজা রাখার অপরিহার্য নিয়ম নাজিল হয়- রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)
সকলের জন্য রোজা ফরজ করার আয়াত নাযিলের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তা রহিত করা হয়েছে। উম্মাহর সকল উলামায়ে কেরাম একমত যে, এই আয়াত প্রমাণ করে যে রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। শরীয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া যদি কোনো ব্যক্তি রোজা না রাখে, তাহলে সে মহাপাপের অংশীদার হবে।
এভাবে রোজাকে ফরজ করার হিকমত হলো উম্মাহর জন্য আইন প্রণয়ন সহজতর করা এবং পর্যায়ক্রমিক নীতি গ্রহণ করা। কেননা রোজা একটি তুলনামূলক কঠিন ইবাদত। মুসলমানরা এর আগে খুব একটা অভ্যস্ত ছিল না। এটা যদি শুরুতেই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে তাদের জন্য এটা কঠিন হয়ে যেত। তাই রোজা ও ফিদায়ার মধ্যে প্রথম স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
তারপর ধীরে ধীরে তাদের ইয়াকিন শক্তিশালী হতে থাকে, মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল হয় এবং ধীরে ধীরে রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। অতঃপর স্বাধীনতা অপসারণ করে শুধুমাত্র রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়।