রামমন্দিরে ফাটলের পর ধসে পড়ল রামপথ
অযোধ্যায় রামমন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি পড়ার পর রামপথটি ধসে পড়েছে। এই ঘটনার জেরে রামমন্দির যাওয়ার প্রধান রাস্তা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভারতের অযোধ্যায় বহুল আলোচিত বাবরি মসজিদ ভেঙে তৈরি রামমন্দিরে ফাটলের পর এবার ধস নামলো ‘রামপথে’। বুধবার (২৬ জুন) রাতে এই ঘটনার জেরে রামমন্দির যাওয়ার প্রধান রাস্তা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) সকাল থেকে অযোধ্যা জেলা প্রশাসন রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২ শে জানুয়ারি রাম মান্দির উদ্বোধন করেন। এর আগে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার ‘যুদ্ধকালীন সময়ে দুই পাশের বাড়ি ভেঙে হনুমানগাড়ি থেকে রাম মন্দির পর্যন্ত সরু রাস্তা প্রশস্ত করেছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রামপথ’। কিন্তু পাঁচ মাস পর প্রথম বৃষ্টিতেই ভেঙে পড়া সড়কের মান নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
প্রসঙ্গত, সোমবারের আগে, রাম মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল ঝরতে শুরু করে, মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস জানিয়েছেন। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে গর্ভগৃহে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল তার ছাদ প্রথম বৃষ্টিতেই ফুটো হতে শুরু করে। বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং কী অভাব রয়েছে তা খুঁজে বের করে মেরামত করা উচিত।
গত সোমবার সত্যেন্দ্র মন্দিরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বলে অভিযোগ করে বলেন, মন্দির থেকে পানি বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টি বাড়লে মন্দিরে পুজো করতে সমস্যা হবে। তবে মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশ্র দাবি করেছেন, রামমন্দির নির্মাণে কোনো প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি বা অন্য কোনো ত্রুটি নেই। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘রামমন্দির নির্মাণে গুণমানের সঙ্গে কোনো আপস করা হয়নি। কিন্তু মন্দিরের বিদ্যুতের তারের পাইপ দিয়ে ভেতরে পানি আসছে। এবং ভক্তদের যাতে বৃষ্টিতে ভিজতে না হয় বা প্রখর রোদে কষ্ট না হয়, সেজন্য অস্থায়ী নির্মাণ করা হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তিনি। বাবরি মসজিদ ভেঙে নির্মাণের ছয় মাস না যেতেই রাম মন্দিরে ফাটল!
ভারতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ শেষে উদ্বোধনের ছয় মাস না যেতেই ছাদ ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি ঝরছে। ছাদ ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরছে । রাম মন্দিরে ‘বিপর্যয়’ শুরু হল বর্ষার প্রথম বৃষ্টির পরই । ছাদে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়তে শুরু করেছে। সোমবার (২৪ জুন) রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সময় বলেন, এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে সারা দেশের প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়াররা রাম মন্দির নির্মাণে যোগ দিয়েছেন। ২২ জানুয়ারি’২০২৪ মন্দিরটি উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু কেন এমন বিপর্যয়?
পুরোহিত আচার্য সত্যেন্দ্র দাস এনডিটিভিকে বলেছেন যে গত শনিবার মধ্যরাতে অযোধ্যায় প্রথম ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তখন মন্দিরের গর্ভগৃহের ছাদে একটি বড় ফাটল দেখা যায়। সেখান থেকে পুজোর বসার জায়গায় ঝরঝরে করে জল পড়তে থাকে। তাছাড়া ভিআইপি দর্শনের জন্য সবাই যেখানে জড়ো হয়েছিল সেখানেও বৃষ্টি হচ্ছিল।
মন্দির নির্মাণে গাফিলতির অভিযোগ তুলে আচার্য দাস বলেন, মন্দির চত্বর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে এই বিপর্যয় ঘটেছে বলে দাবি মন্দির কর্তৃপক্ষের। তবে মন্দিরের ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাদ থেকে পানি পড়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোর পর মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশ্র মন্দিরে পৌঁছে ছাদ মেরামত করে পানি বন্ধের নির্দেশ দেন।
মন্দির নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে পৃথকভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময়, মিশ্র বলেন, প্রথম তলায় কাজ চলছে এবং এই বছরের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিকে আঙুল তুলেছে বিরোধী কংগ্রেস। তারা শহরে মন্দির নির্মাণে বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে, উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান অজয় রায় সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, শহিদদের কফিন হোক বা ভগবানের মন্দির, এ সবই বিজেপি’র কাছে দুর্নীতির সুযোগ হয়ে উঠেছে।
তিনি আরো বলেন, দেশে বিশ্বাস ও পবিত্রতার প্রতীক তাদের কাছে লুটপাটের সুযোগ মাত্র। শুধু তাই নয়, ৬২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রামপথ অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনী সুবিধা পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে মন্দির তৈরি করে অযোধ্যাকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়েছে বিজেপি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২২শে জানুয়ারি(২০২৪) লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তড়িঘড়ি করে মন্দিরের উদ্বোধন করেন। তখনই অভিযোগ ওঠে যে লোকসভা ভোটের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই মন্দিরের ‘চোখ’ দিয়ে উদ্বোধন করা হচ্ছে। এর আগে, ১৫২৮ সালে, সম্রাট বাবরের নামে সর্যু নদীর তীরে তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। সাড়ে চার শতাব্দী পরে এটি ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়। সেনাপতি মীর বাকি ১৮৮৫ সালে বাবরি মসজিদ নির্মাণের ৩৫৭ বছর পর, মসজিদ নিয়ে বিতর্ক ও আইনি লড়াই শুরু হয়। হিন্দুদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করেছিল যে শ্রী রামচন্দ্রের জন্মস্থান ভেঙে তিন গম্বুজ মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল। তারা বলত, রাম মসজিদের ভিতরে একটি উঁচু বেদীর মতো অংশে জন্ম নেন রাম ।
এরপর ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতে বাবরি মসজিদে রাম ও সীতার মূর্তি ফেলে চলে যায় এক অজ্ঞাত হিন্দু চরমপন্থী। এই ঘটনাকে অলৌকিক দাবি করে মন্দিরের ভক্তরা প্রার্থনা শুরু করেন। এই ঘটনার পর, ভারতীয় আদালত ১৯৫০ সালে মসজিদটি বন্ধ করে দেয়।১৯৫৯ সালে নির্মোহী আখরা নামে এক ব্যক্তি হিন্দুদের পক্ষে জমির জন্য মামলা করেন। অন্যদিকে, ১৯৬১ সালে, উত্তরপ্রদেশ মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড মসজিদের জমির মালিকানা দাবি করে মুসলমানদের পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হয়। ১৯৮০-এর দশকে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং তার রাজনৈতিক মিত্র, কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতারা ওই স্থানে একটি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য প্রচারণা চালায়।
১৯৮৬ সালে যখন আদালত মসজিদটি তালাবদ্ধ করার নির্দেশ দেয়, লাল কৃষ্ণ আদবানি ১৯৯০ সালে এই প্রচারণার অংশ হিসাবে বেশ কয়েকটি মিছিল এবং মিছিল বের করেন। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি একটি মিছিল বের করে। এই মিছিল চলাকালীন, চরমপন্থী হিন্দুরা ১৬ শতকে নির্মিত এই মসজিদটিকে সহিংসভাবে শহীদ করে দেয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ৩ এপ্রিল ১৯৯৩ তারিখে সংসদ কর্তৃক পাসকৃত একটি আইনের মাধ্যমে এই জমিটি দখল করে নেয়। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ এ, এলাহাবাদের তিন বিচারপতির বেঞ্চ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহি আখড়া এবং রামলালা, এই জমিটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু ৯ মে, ২০১১-এ, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় স্থগিত করে এবং ৯ নভেম্বর, ২০১৯ শনিবার, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় এই জমিতে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে মসজিদ নির্মাণের জন্য বিকল্প ৫ একর জমি মুসল্লিদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে রাম মন্দির উদ্বোধনের কাজ শুরু হলেও সেই মসজিদ নির্মাণে কোনো অগ্রগতি নেই।