বাংলাদেশের ৭০ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের সিম্পোজিয়ামে বক্তারা বলেন, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার একটি বিপজ্জনক ব্যাধি। এইডস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো মাদকাসক্তিও একটি ভয়ানক রোগ। এটি পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।
সিম্পোজিয়ামে জানানো হয়, দেশের ৭০ লক্ষ মানুষ মাদক সেবন করে। আর তারা এক লাখ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। যা বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উন্নয়ন বাজেটের ৫৬ শতাংশ। গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ জন অভিভাবক মারা গেছেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবে যুব উন্নয়ন পরিষদ আয়োজিত ‘মাদকের ভয়াবহতা, যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নেন বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মো. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গণি চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোঃ হুমায়ুন কবির, অধ্যাপক ডাঃ শামসুল আলম, অধ্যাপক ডাঃ আতিয়ার রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ শহিদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মোঃ সাইফুর রহমান প্রমুখ। রহমান, দেওয়ান মুহাম্মদ সাজ্জাদ প্রমুখ। সিম্পোজিয়ামে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নূর নবী মানিক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন যুব উন্নয়ন সংসদের প্রধান সমন্বয়ক মুহাম্মদ কামাল হোসেন।
আলোচনায় অংশ নেওয়া সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার একটি বিপজ্জনক ব্যাধি। মাদকের ভয়াবহ খপ্পরে পড়ে ধ্বংসের পথে তরুণ প্রজন্ম। শহর থেকে গ্রাম, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সবখানেই মাদক পাওয়া যাচ্ছে। মাদক একটি নীরব ঘাতক। মাদকের কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। যুব সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ংকর মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, মানবতাকে ধ্বংস করছে। পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে, বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে। পরিবার ও সমাজে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।
ডাঃ আব্দুল মজিদ বলেন, মাদকাসক্তি একটি বহুমাত্রিক জটিল সমস্যা। এই রোগ নির্মূল করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারের একার পক্ষে এর সমাধান সম্ভব নয়। মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদক ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন থেকে মাদক দূর করতে এবং মাদকাসক্তি দূর করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনগণের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। সমন্বিত সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি মাদক সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সকল ধর্মীয় নেতা, অভিভাবক, সুশীল সমাজ, অভিভাবকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। .
রুহুল আমিন গাজী বলেন, বাড়ন্ত বয়সের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে কি না সেদিকে নজর দিতে অভিভাবকদের অনুরোধ করছি। মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ হতাশা। তাই হতাশা রোধে তরুণদের নিয়মিত শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা জরুরি বলে মনে করি। দেশের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নে মাদক একটি বড় বাধা।
তিনি বলেন, মাদকের কারণে এদেশে প্রতিনিয়ত অনেক পরিবার ধ্বংস হচ্ছে; অকালে ঝরে পড়ছে অনেক তাজা প্রাণ। সৃষ্টি হয় সামাজিক অস্থিরতা। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বর্তমান বিশ্বে মাদকাসক্তি পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যা আমাদের যুবসমাজকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে। অকালে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ। দাম্পত্য কলহের কারণে অনেক সুখী পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। নেশার করাল ঘাসে মরছে লাখো তাজা প্রাণ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ধ্বংসযজ্ঞ।
এই নেতা সাংবাদিকদের বলেন, দেশের ৭০ লক্ষ মানুষ মাদক সেবন করে। আর তারা এক লাখ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। যা বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উন্নয়ন বাজেটের ৫৬ শতাংশ। গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত শিশু কিশোরের হাতে ২০০ জন অভিভাবক মারা গেছেন।
আঙ্কটাডের (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বরাত দিয়ে কাদের গণি চৌধুরী বলেন, মাদকের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা পাচার হয়। আর মাদক পাচারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এশিয়ার দেশগুলোর কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশ মাদকের মাধ্যমে অর্থ পাচারের শীর্ষে রয়েছে।
অবৈধ মাদকের অর্থ প্রবাহের ক্ষেত্রে মেক্সিকো বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, দেশের উঠতি তরুণদের একটা বড় অংশ ইয়াবা ও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ধনী পরিবারের সবচেয়ে আদরের সন্তানেরা সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নয়, কলেজ ও স্কুলেও মাদক প্রবেশ করেছে। কয়েকদিন আগে বগুড়ায় স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সঙ্গে মাদক সেবনের কারণে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এভাবেই ছুটে চলেছে যৌবনের উত্তাল ঢেউ। ক্রমেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।