আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ১৯৯১সালে ইউনেস্কোর ২৬ তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ অনুসারে, ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩ মেকে বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘পরিবেশ সংকট মোকাবিলায় সাংবাদিকতা’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেশের সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নানা কর্মসূচি পালন করে।
গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র বিশ্বের তথ্যপ্রবাহের প্রাচীনতম এবং গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরবর্তীতে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে রেডিও ও টেলিভিশন যুক্ত হয়। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো পাঠকদের মধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, মুক্ত গণমাধ্যম মানে সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হবেন না। তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারে। এছাড়াও তাদের তথ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয়। ঘোষণার ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; এর মধ্যে রয়েছে হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে মতামত রাখার এবং জাতীয় সীমানা নির্বিশেষে যেকোনো মাধ্যমে তথ্য ও ধারণা খোঁজা, গ্রহণ এবং প্রদান করার অধিকার।’
বাংলাদেশের সংবিধানও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়।‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা’ শিরোনামে সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হইল।
সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। তাই একটি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায়ও এটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম যাতে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে সেজন্য সাংবাদিকদের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া ও নিরাপদ পরিবেশে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আর সাংবাদিকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া মুক্ত গণমাধ্যম পরাজিত হওয়া অনেক দূরের কথা।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য কমবেশি হুমকির শিকার হন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রভাবশালী মহলের চাপ, হামলা-মামলা, রাজনৈতিক হুমকির কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে অনেক ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয়। মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে কম যান না। সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানি করে এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা মোবাইল কোর্টের অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। তবে বর্তমান সরকার ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর’ কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।
কারণ গণমাধ্যম ব্যক্তিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জনমত গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এটি গঠনমূলক সমালোচনা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। এ ছাড়া মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্যও মুক্ত গণমাধ্যম অত্যাবশ্যক। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ও বিকাশের বলিষ্ঠ ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের আয়না। সংবাদপত্র শুধু খবর দেয় না। সমাজের সার্বিক উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। সংবাদপত্র গণতন্ত্রের সদা জাগ্রত অভিভাবক। যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, যখন গণতন্ত্র ব্যাহত হয়, যখন কোথাও দুর্নীতি হয়, তখন মিডিয়াই প্রথম কথা বলে। কুসংস্কার ও কুসংস্কারের মতো বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করে সমাজকে ইতিবাচক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার একটা সীমা আছে। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই করা বা লেখা নয়। সাংবাদিকরা দায়িত্বের ঊর্ধ্বে নয়। তাদের অবশ্যই দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, আইনের প্রতি, নিজের বিবেকের প্রতি, নীতি-নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। তারা বস্তুনিষ্ঠ লেখার সাংবাদিকতার নীতি অনুসরণ করে এবং সঠিক ও সম্পূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে এই দায়িত্ব পালন করবে।
গণমাধ্যমের প্রধান সম্পদ হল এর বিশ্বাসযোগ্যতা, যা বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। তবে নানা কারণে আমাদের দেশের গণমাধ্যম তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এটা সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদার জন্য শুভ ইঙ্গিত দেয় না। তাই সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন তারা কোনোভাবেই হলুদ সাংবাদিকতা, খারাপ সাংবাদিকতা বা দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতায় আক্রান্ত না হয়।