তীব্র গরমে অতিষ্ঠ প্রাণীরাও
সারাদেশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তীব্র তাপপ্রবাহে সৃষ্ট তাপে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু মানুষ নয়, জাতীয় চিড়িয়াখানার বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, হরিণ, হাতি, জেব্রা, জিরাফ, জলহস্তী এবং অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। লোহার খাঁচার সংকীর্ণ সীমানায়, অনেকে তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা বাদ দিয়ে ঘনঘন পানিতে ভিজিয়ে রাখছে বা কিছুটা স্বস্তি পেতে ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। সূর্যের তাপে পাখিরাও হাঁপাচ্ছে। খাঁচার ভেতরে কৃত্রিম ছাউনির নিচে চুপচাপ বসে আছে পাখিরা। তবে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের সুস্থ রাখতে ও পানি সংকট রোধে নিয়মিত স্যালাইন দিয়ে ওয়াটার থেরাপি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
গতকাল জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘুরে দেখা গেছে জীবন্ত চিত্রা হরিণ দলবদ্ধভাবে গাছের ছায়ায় বা শেডের ছাউনিতে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকে গাছের ছায়ায় অলসভাবে হেঁটে সীমানা প্রাচীরের কাছাকাছি চলে গেছে। ময়ূর, উটপাখি, বক রোদে হাঁপাচ্ছে, অনেকে ছায়ায় ক্লান্ত হয়ে বসে আছে। খাঁচার ভিতর বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ক্লান্ত শরীর বের করে দিচ্ছে । কিছুক্ষণ পর বানর হনুমান খাঁচার জলে নিজেকে ভিজিয়ে নিচ্ছে। অজগরটি খাঁচার এক কোণে নিজেকে কুঁকড়ে ধরে, তার ভারী শরীর নিয়ে নীরব। বেশিরভাগ জেব্রা, গাধা, জিরাফ তাদের শেডের মধ্যে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে রেখেছে। কেউ কেউ গাছের ছায়ায় নীরবে বসে আছে । তাদের মধ্যে কোনো চঞ্চলতা নেই। মায়া হরিণ মনে হয় গাছের ছায়ায় ঘাসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে শকুনগুলো ছটফট করছে আর চিৎকার করছে। দেখা যায় বেশিরভাগ কুমিরই মোটামুটি ওজনের। কয়েকটি ছোট বাচ্চা কুমির পানিতে ডুবে আছে । জলাধারের ঘোলা জলে কয়েকটি জলহস্তী ডুবে রয়েছে ।
হাতিদের নিজ নিজ শেডে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারাও গরমে ক্ষুধার্ত, পানির জন্য হাঁপাচ্ছে। হাতির জন্য জলাধার খালি। মনে হচ্ছে কয়েক মাস ধরে এক ফোঁটা পানিও ও পড়েনি সেখানে।
অতিরিক্ত গরমের কারণে চিড়িয়াখানার দর্শনার্থীরাও কম চাপে থাকেন। চিড়িয়াখানার ক্যান্টিনগুলোও প্রায় ফাঁকা। অনেক ফেরিওয়ালা দর্শকের সাথে তাদের বেশিরভাগ সময় অলস সময় কাটাযচ্ছে।
দর্শনার্থীরা বলেন, কয়েক বছর আগে একবার এসেছিলাম। আজ ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এই প্রচণ্ড গরমে বাঘ বা অন্যান্য প্রাণীরা শরীর ডুবিয়ে, আবার কেউ মুখ ডুবিয়ে তাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। অনেকে তাদের শেডের ভিতরে খাঁচায় বা ছায়ায় বসে আছে। প্রচন্ড গরমে ছেলেটাকে শান্ত করতে এসেছি কিন্তু পশুদের ঠিকমতো দেখতে পেলাম না।
সিরাজগঞ্জ থেকে দর্শনার্থী শফিকুর রহমান বলেন, মিরপুরের পল্লবীতে বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছি। ছোট্ট মেয়েটার কারণে আজ চিড়িয়াখানায় এসেছি। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে কিছুই ভালো লাগছে না। পশুগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পেলাম না। বেশিরভাগ প্রাণীই স্থির থাকে। চিড়িয়াখানার শিশু পার্কেও শিশুদের জন্য কোনো রাইড নেই। সেখানে যে কয়েকটির টিকিটের দাম বেশি। বাচ্চা-শকুনদের দেওয়া খাবার পচে গেছে। বানরদের দেওয়া খাবারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, গত কয়েকদিনের তীব্র তাপপ্রবাহ ও প্রচণ্ড গরমে সারাদেশের মানুষ ভুগছে। ঢাকা চিড়িয়াখানার ৭৫ শতাংশ এলাকা বনভূমি হওয়ায় বাইরের তুলনায় তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি কম। কিন্তু এবার অতিরিক্ত গরমের কারণে প্রচণ্ড গরমে পশুদের বাঁচিয়ে রাখতে বাড়তি যত্ন নিতে হচ্ছে। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য বাঘ দিনে দুই থেকে তিনবার তাদের খাঁচায় নেমে আসে। এজন্য আমরা নিয়মিত পানি পরিবর্তন করি। আমি জলহস্তির জন্য ট্যাঙ্কে ঠান্ডা জলের অবিরাম প্রবাহ রেখেছিলাম। এ ছাড়া তারা মাটি নিয়ে শরীরে লাগায়, তাই মাটি দেওয়া হয়। যেসব প্রাণী পানিতে থাকতে পছন্দ করে, আমি চৌবাচ্চার পানি ঠান্ডা রাখতে ঘন ঘন পানি পরিবর্তন করি। কিছু প্রাণীর গায়ে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করেছি। কিছু চালা ঠান্ডা রাখার জন্য বস্তা ভিজিয়ে রেখেছিলাম। পানিশূন্যতা রোধে বারবার স্যালাইন খাবার ও পানি দেওয়া হয়। ইলেক্ট্রোলাইট দেওয়া হয়। শরীর ঠান্ডা করতে খাওয়ানো হচ্ছে ভিটামিন-সি।
তিনি আরও বলেন, পশুদের যত্ন নেওয়ার জন্য কেয়ারটেকার রয়েছে। তারা নিজেদের গবাদিপশুর যত্ন নেয়। খাঁচায় বন্দী পশুর যে কোন সমস্যা তারা সংশ্লিষ্ট শাখা প্রধানদের জানান। যদি কোন অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হয়, আমাদের ভেটেরিনারি টিম তাৎক্ষণিকভাবে তা দেখা দেয়। প্রাণীটি অসুস্থ হলে প্রথমে চিড়িয়াখানার নিজস্ব চিকিৎসক তার যত্ন নেন। কিন্তু পশু বেশি অসুস্থ হলে পশুটিকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তবে কোনো প্রাণী যাতে হিট স্ট্রোকে না হয় সেজন্য আমরা বাড়তি নজর রাখছি।
প্রচণ্ড গরমে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের জন্য পর্যাপ্ত শীতল পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। স্যালাইন ছাড়াও কিছু মৌসুমি ফলও দেওয়া হয়। পশুদের স্বাস্থ্যও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
চিড়িয়াখানায় ৯ প্রজাতির মাংসাশী প্রাণীর মোট ৩৬টি প্রাণী রয়েছে। এছাড়া ২৬১ প্রজাতির বড় প্রাণী (তৃণভোজী), ২৮ প্রজাতির ছোট স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ, ২৫৭ প্রজাতির পাখি, ১১৫৮ প্রজাতির পাখি এবং ২৫ প্রজাতির অ্যাকোয়ারিয়াম মাছ এবং ৯৩৯ প্রজাতির অ্যাকোয়ারিয়াম মাছ রয়েছে।