তনু হত্যার সাত বছর: অগ্রগতি শূন্য বিচারে বিচারের আশা ছেড়েই দিয়েছে পরিবার
মনে পড়ে কি ২০১৬ সালের ২০ মার্চ তনু ধর্ষিত হয়েছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরেই। এবং তাকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় সেনানিবাসেরই ভিতরে। হ্যাঁ সেনানিবাসের ভিতরে এত বড় জঘন্য কাজ কেমনে হলো কেঁপে উঠে সারাদেশ। কিন্তু এই ঘটনাও ভুলে যায় বাংলাদেশের মানুষ। তবে প্রতিবছরই হৃদয়ে দাগ কেটে যায় তনুর জন্য । তবে বিচারিক অগ্রগতি শূন্য এই শাসনব্যবস্থায় তার বিচার পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছে তার শোকে দুঃখে জর্জরিত পরিবার।
সোহাগী জাহান তনুহত্যাকাণ্ডের সাত বছরে চারবার তদন্ত সংস্থা এবং পাঁচবার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে।
সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলা আবারও আলোচনায় এসেছে। হত্যাকাণ্ডের সাত বছর চার মাস অতিবাহিত হলেও মৃত্যু রহস্যের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কয়েক দফা তদন্ত শেষে মামলাটি তদন্ত করেছে পিবিআই।
হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পেরিয়ে গেলেও খুনি শনাক্ত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সোহাগী জাহান তনুর পরিবার বলেছে, বিচার পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তারা। তনুর মা আশঙ্কা করছেন, মৃত্যুর আগে তিনি তার মেয়ের ‘খুনীদের’ বিচার দেখতে পারবেন না।
তনুর পরিবারের অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের সাত বছরে চারবার তদন্ত সংস্থা বদল হয়েছে এবং পাঁচবার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন ছাড়া তদন্তে কোনো আশার মুখ দেখেনি তারা। প্রথমে থানা, পরে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘদিন মামলাটি তদন্ত করেও কোনো লিড পায়নি।
তনুর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পশ্চিম ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে তাদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও কুমিল্লা সেনানিবাসে, তনুর বাড়িতে এবং তার কলেজের ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারে (ভিসিটি) স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, “জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে আছি,প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকি- এরই মধ্যে কয়েকবার হাসপাতালেও গেছি। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি মরে গেলাম। আমার বয়স হয়েছে, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যুর আগে তনুর খুনিদের বিচারটা দেখে যেতে পারবো না। নামাজে প্রতিদিন দোয়া করি- মেয়েকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার যেন আল্লাহ করেন। আমরা গরিব মানুষ, তাই বিচার পাওয়ার আশা এখন ছেড়েই দিয়েছি।“
২০২০ সালের ২১ অক্টোবর সিআইডি তনু হত্যা মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করে। মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআই সদর দফতরের পুলিশ পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই জানিয়ে তনুর বাবা বলেন, “পিবিআই তদন্ত পাওয়ার পর ভেবেছিলাম হত্যার বিচার পাব। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে। মামলা কী অবস্থায় আছে সেটাও জানি না আমরা। “
এদিকে মামলার কাজ ‘এগিয়েছে’ জানিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গুরুত্বের সঙ্গে মামলাটি তদন্ত করছি। ইতিমধ্যে তনু হত্যার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখন গণমাধ্যমে বলা ঠিক হবে না।
তনুর পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি মন্তব্য করেন, “তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে আমি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তনুর পরিবার, স্কুল শিক্ষকসহ অন্যদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আমরা তদন্তে অবহেলা করছি না”
তনু হত্যার ঘটনাকে ‘হিমাগারে’ আখ্যায়িত করে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মী খায়রুল আনাম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি মানুষের মনে রয়ে গেছে। খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এত সময় লাগার কথা নয়। সারাদেশের মানুষ এই হত্যার বিচার চায়।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে অভিনেতা তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তনু তার পরিবারের সঙ্গে সেনানিবাসের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন।হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় ৩০০ গজ দূরে আরেকটি স্টাফ কোয়ার্টারে ছাত্র পড়াতে গিয়েছিলেন তনু।
পরদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তনুর লাশের প্রথম পোস্টমর্টেম করা হয়। ওই দিনই তনুর বাবা কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
পুলিশ, ডিবির মাধ্যমে মামলার তদন্ত যায় সিআইডিতে। আলামত সংগ্রহের পর সিআইডি জানায়, হত্যার আগে তনুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।
২০১৬ সালের ৩০ মার্চ, আদালতের নির্দেশে তনুর লাশ কবর থেকে তোলা হয় এবং দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত করা হয়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ জানিয়েছে, দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তনুর মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি।
পরের বছর ২০১৭ সালের মে মাসে, সিআইডি মিডিয়াকে জানিয়েছিল যে তনুর জামাকাপড় থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষায় তিন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া গেছে। এছাড়া তনুর মায়ের সন্দেহভাজন তিনজনকে ঢাকা সেনানিবাসে ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত সিআইডির একটি দল জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে সে সময় তাদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করেনি সিআইডি।