পাখি প্রেমে চিরকুমার ৮৭ বছরে আকাশ কলী দাস
চারপাশে গাছ আর সবুজ। ঘন জঙ্গলে ঘেরা পুরনো টিনের ঘরে বসবাস। সেই বাড়িটিকে ঘিরে প্রকৃতি। দর্শনার্থী । পাখির ঝাঁক। পাখির কিচিরমিচির এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আবহ ।
পাবনার বেড়া উপজেলার কাইটোলা গ্রামে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছেন আকাশ কলী দাস। তিনি তার সাড়ে ছয় বিঘা জমি পশুর জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। পশুর অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন। আকাশ কলী দাস তার বোন ঝর্ণা দাসের সাথেই থাকেন। ভাই-বোন চিরকাল প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন ছিলেন।
আকাশ কালী দাস অর্ধশত বিঘা জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত বিনয়ী জীবনযাপন করেন। জীবজন্তু ও প্রকৃতির প্রতি তার অগাধ মমতা। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি ঘরটি খুলেছিলেন। তাদের প্রেমে পড়েও তিনি চিরকুমারই থেকে যান। বন বিভাগ আকাশ কলী দাসের পক্ষে সচেষ্ট বিদ্যমান , যিনি চোরাশিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এলাকাবাসীর কাছে তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র।
আলাপকালে আকাশ কলী দাস জানান, তার বাবা চন্দ্র কুমার দাস পাবনার নগরবাড়ী এলাকার শ্রী নিবাস দিয়া জমিদার বাড়ির নায়েব ছিলেন। ১৬-১৭ বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলে, আকাশ কলী দাস পরিবারের দায়িত্ব নেন। তিন ভাই ও তিন বোনের সংসারে তিনি ছিলেন অভিভাবক। ছোট ভাই মারা গেছেন। বাকি এক ভাই ও দুই বোনের বিয়ে হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে আকাশের কোনো যোগাযোগ নেই।
এক সময় একই উপজেলার মাছখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আকাশ কলী দাস। তখন থেকেই তিনি প্রাণী ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। ২৫থেকে ২৭ বছর আগে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি এখনও ভূমি ও প্রকৃতির সংস্পর্শেই রয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সহযোগিতা রয়েছে। সাড়ে ছয় বিঘা বসতবাড়ি ছাড়াও মাঠে রয়েছে অর্ধ শতাধিক বিঘা জমি। বাড়িতে গরুর খামার আছে।
শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে পশু-পাখিই তাদের একমাত্র সঙ্গী। ইট-পাথরের ভেরাজাল আর ধ্বংসের কারণে পাখিরা যখন তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে, তখন নিরাপত্তার জন্য তিনি তার আবাসস্থল খুলে দিয়েছেন। সেখানে যে কেউ পাখি শিকার করার চেষ্টা করলে তিনি কঠোরভাবে প্রতিহত করেন। আকাশ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষা করে আসছে।
স্বাধীনতার আগে ও পরে আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করলেও তার মধ্যে অনেক উদারতা রয়েছে। তিনি ১৯৭৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। পাবনা ও দেশের রাজনীতির অনেক উত্থান-পতনও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে চান না তিনি।
আকাশ কালী দাসের বয়স ৮৭ বছর, আর তার বোন ঝর্ণা দাসের বয়স ৭৩ বছর। তারা এখনও কুমারী। বড় ভাই বাড়ির আঙিনার বাইরে থাকলেও বোন লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রতিবেশীদের অনেকেই এখনো তাকে দেখেনি। আকাশ কলী দাস দাবি করেন, কেন তিনি বিয়ে করেন না এবং কেন তাঁর বোনের বিয়ে হয় না তা তাঁরা জানেন না। পশু-পাখিই তাদের একমাত্র সঙ্গী।
আকাশ কলী দাস মনে করে এই পৃথিবীতে একা এসেছে, তাকে একাই যেতে হবে। জমি, সম্পদ কিছুই সঙ্গে যাবে না। তাই প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়াতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। বা জেল জরিমানা কোনো সমাধান নয়। সরকার চাইলে তার আশ্রয়কে ঘিরে পরিকল্পনা করতে পারে। যাতে কোনো প্রাণীর শিকার না হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশী অনেকে জানান, আকাশ কলি দাস শিক্ষক হিসেবে ভালো মানুষ ছিলেন এবং তিনি প্রকৃতি ও পশুপাখি ভালোবাসতেন এবং তার সর্বস্ব দিতেন। এটি একটি অনন্য উদাহরণ। তার উদ্যোগে গ্রামের মানুষ তার পাশে রয়েছে।
আকাশ কলী দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন যুগ ধরে এখানে পাখি আসা শুরু করে। প্রথমে দেশি পাখি এলেও পরে অতিথি পাখিও আসতে শুরু করে। পাখিরা এখানে আসে মূলত খাবারের সহজলভ্যতা এবং শিকারীদের থেকে কম সহিংসতার কারণে। পাখির আগমন দেখে সে পাখির প্রেমে পড়ে যায়। তাদের ভালবাসেন তিনি । আমার মনে হয় এখানে পাখিরা নিরাপদ থাকবে। তাই সে বনের কোনো গাছ বিক্রি করে না। শিকারীদের দ্বারা প্রথমে সমস্যায় পড়লেও গ্রামবাসীর সহায়তায় সে তাদের সাথে লড়াই করে। কয়েক বছর আগে সরকার ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য পুনর্বাসন প্রকল্প জায়গাটিকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। তবে কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন পাখির উপস্থিতি কমে গেছে। যদিও অভয়ারণ্যে পাখি শিকার করা হয় না, তবে আশেপাশে প্রচুর পাখি রয়েছে। ফলে অনেক পাখি খাবারের সন্ধানে নদীর তীরে বা ধানক্ষেতে যায় এবং আর ফিরে আসে না।
আকাশ কলি দাস বলেন, পাখিরা মাঠে গেলে মানুষ নানাভাবে শিকার করে। তাই তারা এখানে এসে নিরাপদ স্থানে বসবাস করছে। পশুপাখি ভালোবাসি। গাছগাছালি কাটি না; যাতে করে ওরা থাকতে পারে। আমি ওদের পাহারা দিয়ে রাখি। যাতে পাখিদের ওপর অত্যাচার না হয়, সে জন্য আমি ধীরে ধীরে এই জঙ্গল গড়ে তুলেছি। আমার একমাত্র চিন্তা পাখিদের নিরাপত্তা।