এক বছরে তিন হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ
[কোনো কারণে চুক্তির শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর যখন কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা না হয়, তখন সেই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে।]
“ঋণ খেলাপির বেশ কিছু কারণ আছে, তার একটি হল পর্যাপ্ত ‘নিরাপত্তা বা সিকিউরিটি না থাকা ‘ , বিষয়টিকে খুবই তুচ্ছভাবে মূল্যায়ন করা । আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বাইরের চাপ, আর এখানে রাজনীতিই প্রধান কারণ।”
অর্থাৎ যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের সমর্থিত লোকজন জোর করে ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ করে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মালিক যেহেতু সরকার, ফলে ঐ ব্যাংকে নিজের রাজনৈতিক লোকজন যখন ক্ষমতা প্রয়োগ করে, সেটা কন্ট্রোল করার ক্ষমতা থাকেনা।
এর অর্থ হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
“কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দায়িত্ব হল অন্য ব্যাঙ্কগুলির ব্যবস্থাপনার উপর নজরদারি করা। কারণ ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের বড় অভাব, সেগুলি বেসরকারি খাত হোক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন।”
যার কারণে এই ঋণ ফেরত না দেওয়া বা জালিয়াতির মতো নানা ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটছে। এগুলো দেখলে বোঝা যায়, ঋণ ফেরত আনতে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল তা আমরা করতে পারিনি।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন কোনো উদাহরণ তিনি দিতে পারেননি।
এক অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থ বছরে (২০২২-২৩) বেড়ে ৫৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৫৮ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। চূড়ান্ত হিসেবে কিছুটা কমবেশি হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, এই ঋণের পরিমাণ বেশি হবে। কারণ, কোম্পানিটি সন্দেহজনক ঋণ খেলাপি, আদালতের আদেশে স্থগিতাদেশের অধীনে ঋণ, পুনঃনির্ধারণ ও পুনর্গঠন ঋণের পক্ষে।
জানা গেছে, খেলাপি ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মামলা দেশের আদালতে বিচারাধীন। সেখানে আটকে আছে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া একই সময়ে খেলাপিদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টাকা আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। অর্থবছরের শুরুতে শ্রেণীবদ্ধ ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অর্জিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান পরিণতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের বিপরীতে সংস্থাটি যে শর্ত দিয়েছে তা হলো, মন্দ ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, মন্দ ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মন্দ ঋণের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। . কিন্তু এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কোনো লাভ নেই। এটি অর্জনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা দেখার বিষয়। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতেও রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।
আরও পড়তে
খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মামলার ভিত্তিতে খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এর ফলও পাওয়া যাবে। বেসিক ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে একটি এপিএ (পারফরমেন্স চুক্তি) করেছে। আশা করি এটা অর্জন করা যাবে। একই ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও আদায়ে কঠোর অভিযান শুরু করেছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বিশেষ করে এই ব্যাংকের স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিরা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য শাখাগুলোকে তাদের পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আলোকে আদালতের অনুমতি নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু খেলাপির পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে জমা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য খেলাপিদের পাসপোর্টও পর্যায়ক্রমে জমা দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে খেলাপিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেসিক ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি ঋণের অবস্থা ৭০০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা এবং খেলাপিদের কাছ থেকে ১৬০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে। সমাপ্ত অর্থবছরে ১৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে বেসিক ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টদের মতে, খেলাপি ঋণ আদায়ে দেশে কিছু আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাব রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কখনোই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং তারা সব সময়ই নানা সুবিধা পেয়েছে। যার কারণে খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। তবে ভিয়েতনাম, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশ কঠোর আইন প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে।