গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা পেয়েছে কমিশন
বাংলাদেশে বিভিন্ন গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিশন। দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় কর্মসূচি এবং বন্দীদের সম্ভাব্য ভাগ্য সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য তুলে ধরে কমিশন তার প্রতিবেদনে বলেছে, “বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা জনমনে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।” শনিবার (২১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
এতে বলা হয়, সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন সম্প্রতি রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘সত্য উন্মোচন’ শীর্ষক প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যে একটি দৃঢ় ইঙ্গিত রয়েছে যে কিছু বন্দী এখনও ভারতীয় কারাগারে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করে কমিশন বলেছে, ‘আমরা পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করছি, যেন তারা ভারতে এখনো বন্দি অবস্থায় থাকতে পরে এমন যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিককে খুঁজে বের করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সীমানার বাইরে এই বিষয়টি তদন্ত করা কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ।’’
প্রতিবেদনে উল্লিখিত দুটি বহুল আলোচিত অন্তর্ধান এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল তা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করে। দুটি ঘটনার মধ্যে একটি ছিল সুখরঞ্জন বালি, যাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে অপহরণ করে ভারতীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অপরজন ছিলেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ।
এসব ঘটনার পাশাপাশি হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, ‘তাকে কারাগারের বাইরে হিন্দিতে কথা বলতে শোনা যায়, জিজ্ঞেস করা হয়, তাকে কবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? তিনি কি কোনো তথ্য দিয়েছেন? তাকে কি এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে? ইত্যাদি’
কমিশন বলেছে, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের মামলাটি বাংলাদেশ-ভারত বন্দি বিনিময় ব্যবস্থার কিছু কাজের উদাহরণ দেয়। ২০১৫ সালে উত্তরায় আত্মগোপনের সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পরে, তিনি বলেছিলেন যে তাকে মেঝেতে ছিদ্রযুক্ত একটি পরিত্যক্ত কক্ষে রাখা হয়েছিল, যা টয়লেট হিসাবে ব্যবহৃত হত।
বাসস রিপোর্টে বলা হয়েছে,সালাহউদ্দিন আহমেদকে দেয়া কম্বলটিতে ‘টিএফআই’ অক্ষরগুলো লেখা ছিল, যা ‘টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন’-এর ইঙ্গিত বহন করে।
তারা জানান, ওই সময়ে একমাত্র সক্রিয় টিএফআই সেন্টারটি র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তত্ত্বাবধানে ছিল, যেটি র্যাব সদর দফতরের অধীনে কাজ করে। এটি ঢাকার উত্তরায় র্যাব-১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের একটি প্রাচীর ঘেরা স্থাপনার ভেতরে ছিল।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাক্ষীদের সাক্ষ্য ওই প্রাঙ্গণের বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করতে আমাদের সাহায্য করেছে, যার মধ্যে রয়েছে, কুখ্যাত নির্যাতন কক্ষ ও সেলের অবস্থান।’
তারা জানান, ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে ও মাঝামাঝি সময়ে টিএফআই কেন্দ্র পরিদর্শনকারী সেনা সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এক সময় এই স্থাপনাতে বেশ কিছু সেলসহ অতিরিক্ত একটি তলা ছিল, বর্তমানে এটিতে আর প্রবেশ করা যায় না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা এখনও আরও প্রমাণের অপেক্ষায় আছি। তবে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে যে, সালাহউদ্দিন আহমেদ বর্তমানে নষ্ট করে ফেলা সেলগুলোর একটিতে আটক ছিলেন। সালাহ উদ্দিন জানান যে, তাকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডের বেশ ভেতরে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক প্রকৃতি এবং এ সময় পরিচয় গোপন রাখতে ‘জম টুপি’ পরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহভাজন সদস্যদের উপস্থিতি থেকে এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, দুই দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাব গোয়েন্দা শাখায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের কার্যক্রম এবং আটক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একজন সেনা সদস্য বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ২০১১ সালের দিকে দুটি পৃথক ঘটনায় র্যাব গোয়েন্দা শাখা তামাবিল সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে ভারত থেকে তিনজন বন্দি গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সেখানে ইউনিফর্মধারী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে ‘একটি ঘটনায় দুইজন বন্দিকে গ্রহণ করার পর রাস্তার পাশে হত্যা করা হয়। অন্য একটি ঘটনায়, একজন বন্দিকে জীবিত অবস্থায় গ্রহণ করে বাংলাদেশে আরেকটি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এর বিনিময়ে, র্যাব গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশের দুই বন্দিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে।’
কমিশন জানায়, সেনা সদস্য বন্দিদের নাম জানাতে না পারলেও এই ধরনের আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা পরিষেবা সমন্বয় গুমের ঘটনাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতি নির্দেশ করে।’
কমিশন মনে করে ‘তবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কতটা সম্পৃক্ত ছিল এবং দু’দেশের জন্য এর তাৎপর্য কী তা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন।’