দৃষ্টি সমস্যা মায়োপিয়ায় ভুগছে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ শিশু
বর্তমানে বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন শিশু মায়োপিয়া নামক চোখের রোগে ভুগছে। এই রোগে আক্রান্তরা দূরদৃষ্টিতে ভোগে, অর্থাৎ তাদের কাছে স্বাভাবিক দূরত্বের বস্তুগুলি ঝাপসা হয়ে যায়। যুক্তরাজ্যের একদল চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। তারা বিশ্বের ৬টি মহাদেশের বিভিন্ন বয়সের ৫০ লাখ শিশুর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি গবেষণা পত্র তৈরি করেছে। প্রবন্ধটি বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল Journal of Ophthalmology-এ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবন্ধে গবেষকরা বলেছেন, এশিয়া মহাদেশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এই মহাদেশের অর্ধেকেরও বেশি শিশু দৃষ্টি সমস্যায় ভোগে। এক্ষেত্রে এই মহাদেশের দুটি উন্নত দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। জাপানে ৮৫% এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭৩% রোগীর মায়োপিয়া আছে।
চীন এবং রাশিয়ার শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার ৪০ শতাংশের বেশি। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত শিশুর ১৫ শতাংশ এই সমস্যায় ভুগছে।
তুলনায়, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় মায়োপিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা খুবই কম, যার শতকরা হার মাত্র ১ শতাংশ। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের হার ৩৬ শতাংশের বেশি বেড়েছ।
মায়োপিয়া প্রধানত জেনেটিক। পিতামাতা বা নিকটাত্মীয়ের যদি এই সমস্যা থাকে তবে এটি উত্তরাধিকারের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। যাইহোক, বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার এই প্রবণতা কেবল জেনেটিক্সের কারণে নয়, আরও কিছু প্রভাবও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে যে জন্মের পর থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের চোখ তৈরি হতে থাকে। যদি একজন ব্যক্তি অল্প বয়সে চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ অনুভব করেন, তবে তাদের মায়োপিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা কখনোই নিরাময় নাও হতে পারে।
এক গবেষণা পত্রে ব্রিটিশ চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেসব দেশে শিশুরা অল্প বয়সে স্কুলে ভর্তি হয় সেসব দেশের শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ শিশুর দৃষ্টি সমস্যার প্রধান কারণ।
দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার অনেক কম পাওয়া গেছে। এই দুটি অঞ্চলে, শিশুরা গড়ে ৭ বা ৮ বছর বয়সে স্কুলে প্রবেশ করে।
এ ছাড়া করোনা মহামারির পর শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কারণ মহামারী চলাকালীন, শিশুরা দিনের পর দিন তাদের ঘরে সীমাবদ্ধ ছিল এবং প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা টেলিভিশনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব বৈদ্যুতিক গ্যাজেট থেকে আসা রশ্মি দিনের পর দিন চোখে প্রবেশ করলে শিশুদের দূরদৃষ্টি কমে যায়।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তা থেকে জানা যায় যে করোনা মহামারী বিশ্বজুড়ে এই মায়োপিয়ায় আক্রান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই মহামারী চলাকালীন ইলেকট্রনিক গ্যাজেটগুলির উপর আমাদের বাচ্চাদের অতিরিক্ত নির্ভরতা শুরু হয়েছিল।”
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে মায়োপিয়ার প্রকোপ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রধান কারণ হল ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বাইরের কার্যকলাপ এবং খেলাধুলার প্রতি কম প্রবণ।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি শিশু মায়োপিয়ায় ভুগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মায়োপিয়ার লক্ষণ
এই রোগের লক্ষণগুলো হলো
- স্বাভাবিক দূরত্বে বস্তু দেখতে অসুবিধা। উদাহরণস্বরূপ, স্কুল বোর্ডে লেখা অস্পষ্ট
- শিশুদের টিভি বা কম্পিউটার স্ক্রীন, মোবাইল বা ট্যাবলেট টেক্সট মুখের কাছাকাছি বসার প্রবণতা।
- মাথাব্যথা
- ঘন ঘন চোখ কাঁপানো
মায়োপিয়া থেকে শিশুদের সুরক্ষা
ব্রিটিশ চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও চক্ষুবিজ্ঞানীরা বলেন, মায়োপিয়ার কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ-
- দেড় থেকে ৯ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুর প্রতিদিন কমপক্ষে দুই ঘন্টা সূর্যের আলোতে বাইরে কাটানো উচিত।
- যেসব বাবা-মায়ের ৭থেকে ১০ বছর বয়সী সন্তান রয়েছে তাদের বছরে অন্তত একবার তাদের সন্তানের চোখ পরীক্ষা করা উচিত।
- সম্প্রতি বাজারে বিশেষ কন্টাক্ট লেন্স পাওয়া যায়। ছোট বাচ্চারা যারা মায়োপিয়ায় ভুগছে তাদের জন্য এই লেন্সগুলি রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তবে এই বিশেষ লেন্স ব্যবহার করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।