রক্তাক্ত রবিবার: বাংলাদেশে একশোর উপর নিহত
শুধুমাত্র একটি অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার লালসাকে কেন্দ্র করে এবং অযাচিত মুখের শব্দবুলিতে রক্তাক্ত আজ সোনার বাংলাদেশ। এর জবাব জাগ্রত ছাত্র-জনতা সহকারে লক্ষ কোটি মানুষ দিয়েই ছাড়বেন ইনশাআল্লাহ। সারাদেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী অন্তত ১০৩ জন নিহত হয়েছে।
গতকাল দেশের অন্তত ৫০টি জেলায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ জায়গায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। সরকার সমর্থকরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের অনেককে পিস্তল, শটগান, বন্দুক, রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে দেখা গেছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন শতাধিক।
এ কর্মসূচিকে ঘিরে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের বাসভবন এবং বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীদের অসহযোগ আন্দোলনে গতকাল সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ছাড়েনি। রাজধানীতে গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে।
বেশিরভাগ জায়গায় সংঘর্ষের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তেমন দেখা যায়নি। তারা প্রধানত সরকারি ভবন রক্ষায় বেশি মনোযোগী ছিল। পুলিশ অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা প্রায় সব জায়গায় পুলিশের সঙ্গে ছিলেন। দিনব্যাপী সংঘর্ষের পর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। তবে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত কোথাও কোথাও সংঘর্ষ চলছিল বলে খবর পাওয়া গেছে।
রক্তাক্ত বাংলাদেশ। লাশের মিছিল। নজিরবিহীন গোলাগুলি, সংঘর্ষ, সংঘর্ষ। শতাধিক মানুষ নিহত হয়। নিহতদের অধিকাংশই বিক্ষোভকারী। সহিংস হামলায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া কুমিল্লায় আরও এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশ এমন দিন আগে কখনো দেখেনি।
সারাদিনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। জেলায় হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। গোটা দেশ যেন যুদ্ধক্ষেত্র। একই অবস্থা রাজধানী ঢাকাতেও। মোড়ে মোড়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে বিভিন্ন স্থানে গুলি চালাতে দেখা গেছে। তাদের কাছে রামদা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র ছিল। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। শনিবার আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করলে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সারা রাত ধরে সরকার সমর্থকরা আন্দোলনকারীদের সতর্কবার্তা জারি করে। তারই প্রতিফলন দেখা গেছে গতকাল।
দিনের শুরুতে অবশ্য শিক্ষার্থীরা শাহবাগের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ সময় আন্দোলনকারীদের মুখে পিছু হটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু পরে তারা দিনভর বাংলামোটর থেকে হয়ে গুলি চালায়। সংঘর্ষ ধীরে ধীরে ঢাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় সরকার সমর্থকরা। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলাও করেছে আন্দোলনকারীরা। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নতুন করে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। বিকেলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে আজ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় সারাদেশ থেকে আন্দোলনকারীদের রাজধানীতে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিরোধী দলগুলো।
দিনব্যাপী সংঘর্ষে অন্তত শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অতিরিক্ত চাপে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। আহত ও মৃতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স মিনিটে মিনিটে ঢাকা মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছায়।
রাজধানীতে অন্তত ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৯টি জেলায় পুলিশসহ অন্তত ৯১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের বেশির ভাগই
ছাত্র। তার সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী ও পুলিশও নিহত হয়। তবে নিহতদের অধিকাংশই ছাত্র। এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের হামলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ ২৩, লক্ষ্মীপুরে ১০, ফেনীতে ৮, নরসিংদীতে ৬, কিশোরগঞ্জে ৪, মুন্সীগঞ্জে ৪, রংপুরে ৫, সিলেটে ৬, মাগুরায় ৪, পাবনায় ৩, বগুড়ায় ৪, কুমিল্লায় ৪, বরিশালে ২, শেরপুরে ২, ভোলায় ১, জয়পুরহাটে ১, সাভারে ১, হবিগঞ্জে ১, কক্সবাজারে ১ জন ও কেরানীগঞ্জ ১ জন রয়েছেন।