জুয়া: খেলতে খেলতে হয় মানসিক রোগী
যেহেতু প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন রয়েছে এবং সবাই কমবেশি প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তাই লোভে অনেকেই অনলাইন জুয়া খেলার দিকে ঝুঁকছেন। এ ধরনের জুয়া আসক্তরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত। দল বেঁধে জুয়া খেলতে বসেছে বেশ কয়েকজন। সবাই প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকার জুয়া খেলে। জুয়ার টাকা ডলার থেকে বাংলাদেশি টাকায় ভেঙ্গে যায়। অনেক যুবক ও তাদের পরিবার এ ধরনের জুয়ায় প্রাণ হারিয়েছে। কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যা করছেন।
মানুষ যখন জুয়া খেলার তাগিদ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না, তখন এটি একটি মানসিক রোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পর্যায়ে একজন ব্যক্তি জুয়ার জন্য সর্বস্ব হারালেও সে জুয়ার নেশা ছাড়তে পারে না। আর এই আসক্তি যখন চরমে পৌঁছায় তখন তা মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জুয়ার আসক্তির মতো মানসিক রোগগুলি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এবং বারবার পুনরাবৃত্তি হয়। জুয়ার আসক্তি বা জুয়ার আসক্তি যখন মানসিক রোগে পরিণত হয় তার বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। তা হল-
- তাদের সবসময় জুয়া সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণা থাকে (উদাহরণস্বরূপ, তারা আগের জুয়া খেলার অভিজ্ঞতা ভুলে যায় এবং পরবর্তী খেলার পরিকল্পনা করে, অর্থের ব্যবস্থা করে)।
- জুয়া খেলা এই ধরনের লোকদের তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আর্থিক ক্ষেত্র এবং কাজের জগতে ক্ষতির কারণ হয়।
- তারা জুয়া খেলে মূলত জীবনের ছোট-বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে বাঁচতে বা মানসিক দুশ্চিন্তা, অপরাধবোধ, অসহায়ত্ব, বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
- তারা জুয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয় না।
- তারা তাদের জুয়ার আসক্তি অন্যদের থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করে।
- তারা জুয়ার নেশায় নিজেদের এতটাই জড়িয়ে ফেলে যে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বকে তারা অবহেলা করে।
- তারা জুয়া খেলে অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন শুরু করে। তারা জুয়া খেলার জন্য অন্যদের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং ধীরে ধীরে নিজেরাই ঋণগ্রস্ত হয়।
- এবং এই পরিস্থিতিতে জুয়ার মতো আসক্তিপূর্ণ আচরণ পছন্দ করা হয়।
- পারিবারিক ইতিহাস, বর্ধিত চাপ, মাদকাসক্তি এবং বয়স সবই জুয়া খেলায় ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যান্য আসক্তি সমস্যার মতো, জুয়ার আসক্তি পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
জুয়ার আসক্তির সাথে সম্পর্কিত মানসিক সমস্যাগুলি সাধারণত দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় এবং সঠিকভাবে চিকিত্সা না করা হলে অন্যান্য অনেক জটিলতা হতে পারে। সেই সমস্যাগুলো হলো-
- মাদকের প্রতি আসক্তি চরমে উঠে যায়।
- ইনভেলিড সেক্সওয়াল টেনডেন্সি গ্রো করে।
- ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং আর্থিক সমস্যা যেমন দেউলিয়া বা দেউলিয়াত্ব বেড়ে যায়।
- জুয়া খেলার উত্তেজনা মানুষকে হৃদরোগে আক্রান্ত করতে পারে।
- উদ্বেগ সমস্যা কঠিন থেকে আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
- আত্মঘাতী হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
এমতাবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জুয়া আসক্তের পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া পরিবারের ভূমিকাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একজন কর্মকর্তা বলেন, অনলাইন জুয়া খেলার ওপর নজরদারি করার কেউ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিটিআরসি এখন পর্যন্ত শতাধিক অনলাইন জুয়া খেলার সাইট বন্ধ করেছে।
উল্লেখ্য, বালিয়াডাঙ্গী: ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে অনলাইন জুয়ায় টাকা হেরে রাজিউর রহমান রাজু নামে এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। গত ৪ মে রাতে বেডরুম থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। রাজুর স্ত্রী মর্জিনা বেগম সাংবাদিকদের জানান, রাজু গত ছয় মাস ধরে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। সেদিন সারাদিন বাড়িতে একা একা অনলাইনে জুয়া খেলছিলেন তিনি। তার কাছে ৭০ হাজার টাকাও ছিল। স্থানীয় বাজার থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যালেন্স নিয়ে ঘরে বসে ক্যাসিনো খেলা। সব টাকা হারিয়ে সে আত্মহত্যা করে।
গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় পিপলু দে নামে এক যুবক গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নিহত পিপলু দে চন্দনাইশ উপজেলার কাঁচনগর এলাকার জগদীশ দে-এর ছেলে। জানা গেছে, অনলাইন জুয়ায় সর্বস্ব হারিয়ে লোহাগাড়ার বটতলী মোটর স্টেশনের ডা. মাহমুদুর রহমানের ভাড়া বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। নগরীতে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে। আবার অনেকে জুয়ার টাকা বাঁচানোর উপায় হিসেবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, নতুবা জুয়ায় সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রামে অনলাইন জুয়ার নেশায় অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছেন। কেউ আবার বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। চট্টগ্রামের বনেদী সওদাগরী পাড়া চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও হাজারী গলিতে ব্যবসার আড়ালে জুয়ায় মত্ত হয়ে উঠছে কয়েকজন ব্যবসায়ী। স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই মৃত্যু খেলায় জড়িয়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। মহানগর ছাড়াও পল্লীগ্রামেও জুয়ার নেশা ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অনুষ্ঠানে প্রতিদিন তিন-চার কোটি টাকা বিনিময় হয়। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।