সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত রহস্যজনকভাবে এড়ানো হচ্ছে: বিএনপি
রাজধানী ঢাকায় নিজ বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহরুন রুনি হত্যার প্রকৃত তদন্ত রহস্যজনকভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
সোমবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি হত্যার এক যুগ পূর্ণ হলো গত ১১ ফেব্রুয়ারি। দুঃখজনক—এমনকি এক যুগেও এই বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত কখনোই হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রহস্যজনকভাবে প্রকৃত তদন্ত এড়িয়ে যাচ্ছে। সাগর-রুনির খুনিরা হত্যার পর বাসা থেকে ল্যাপটপ নিয়ে যায়, কিন্তু ১২বছর পরও উদ্ধার হয়নি ল্যাপটপ। ঠিক তেমন প্রকাশ পায়নি, সেই ল্যাপটপে কী লুকানো ছিল তার কোনো তথ্য। অবিশ্বাস্য ঘটনা হল, আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ এ পর্যন্ত ১০৫ বার পিছিয়েছে। বহুমাত্রিক বিশ্ব রেকর্ডের মধ্যে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-দুঃশাসন-দুর্নীতিতে ১০৫ বার একটি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গোপন করার আরেকটি নজিরবিহীন বিশ্ব রেকর্ড!
রিজভী বলেন, গত ১২বছরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার কারণ হতে পারে যে সাগর-রুনির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কিছু প্রমাণ প্রকাশ করেছে এবং তারা কিছু জিনিস জানতে পেরেছে, যা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ক্ষমতাসীনদের জন্য হুমকিস্বরূপ। যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছিল সাগর-রুনির সাংবাদিকতার অন্যতম বিষয়, যে খাত থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে লাখ-লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, সেই খাতের লুটপাট তথা নেপথ্যেও কুশীলবদের সঙ্গে এই হত্যা ও বিচারহীনতার সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়!’!
তিনি বলেন, “সারা বাংলাদেশে খুন, গুম, খুন, অপহরণসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ১০ বছরে ৩০ জন সাংবাদিক এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন, যার বিচার আজও হয়নি। গত ১৫ বছরে সাংবাদিকদের হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজারেরও বেশি। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট ও স্বার্থান্বেষী মহলের দায়ের করা মামলায় বিশ্বের ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৬৩তম।
সাগর-রুনি হত্যার এক যুগ, কারণ এখনো জানা যায়নি।
১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহরুন রুনি হত্যার এক যুগ পূর্ণ হলো। এত বছর পার হলেও বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের কারণ জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঘটনাস্থল থেকে দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে বলে পাঁচ বছর আগে আদালতে দাখিল করা অগ্রগতি প্রতিবেদনে র্যাব জানিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই দুজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত ১০৫ বার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছানো হয়েছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। সাগর তখন বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙা টিভিতে এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন।
সাংবাদিক সাগর সারওয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি সাগর-রুনির প্রকৃত খুনিরা ধরা না পড়া পর্যন্ত তাদের কবর জিয়ারত করব না। কিন্তু আমি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারি না।
এক যুগেও খুনি ধরা না পড়ায় চরম হতাশ সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা মনির। আমি প্রায়ই অসুস্থ. কখন কি হয় জানি না। তাই ভাবলাম, শিগগিরই সাগর-রুনির কবর জিয়ারত করতে যাব।
হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, তদন্তে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে।
এদিকে, ছয় দিন আগে ৫ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেন, একটি বিষয় আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, তদন্তকারীরা হত্যার ইয়ে (রহস্য) উদঘাটন না করা পর্যন্ত তদন্ত শেষ করা ঠিক হবে না। ” এই মামলার তদন্ত একটু কঠিন। তদন্তকারী সংস্থা মামলাটি যথাযথভাবে তদন্ত করবে। যারা অপরাধী, অবশ্যই তাদের ধরা হবে।
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে মামলাটি তদন্ত করছে। চারদিন পর মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে। তবে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিন পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী বলেছিলেন খুনিরা শনাক্ত না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে ।
সাগরের মা কান্না করে বলেন, ‘সিআইডি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ), পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ও র্যাব মিলে অনেক খুনের মামলার উন্মোচন করেছে। আমি বিশ্বাস করি, খুনি যেখানেই থাকুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে র্যাব সাগর-রুনির খুনিদের ধরতে পারছে না, সেটা বুঝতে পারছি না।
হত্যাকাণ্ডের সময় সাংবাদিক দম্পতির ছেলে মাহির সরোয়ারের (মেঘ) বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। সে এখন ইংরেজি মাধ্যমে ‘ও’ লেভেলে পড়ছে।
রুনির মা নূরান নাহার মির্জা বিচার না দেখে দুই বছর আগে মারা যান।