শ্রমিকরা পাচ্ছেননা ন্যূনতম মজুরিওঃ একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টস
যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর বুক জড়ানো ঘামে মালিক পক্ষের লোকজনের বিলাসিতা। বেগম-পাড়াসহ দুনিয়ার উন্নত স্থানগুলোতে বিশাল অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। সেই পরিশ্রমী শ্রমিকদের প্রাপ্য এবং যা মালিকপক্ষের স্বার্থ কি ঠিক রেখেই অযৌক্তিকভাবে নির্ধারিত। ওই নূন্যতম মজুরি দিতেও নারাজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা গার্মেন্টস মালিকরা।
এ বিষয় নিয়েই আজকের সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ
বেশ কিছুদিন ধরেই পোশাক শিল্পে তোলপাড় চলছে। নির্বাচনের আগে নভেম্বরে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে আন্দোলনের সময় শত শত পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে শিল্পের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা সামনে আসে।
সরকার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পর শ্রমিকরা অসন্তোষ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে কাজে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো (ডিসেম্বরের বেতন) বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা আমলে নেয়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ বলেছেন যে তারা নতুন কাঠামোর অধীনে অর্থ প্রদান করতে পারবেন না। ফলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে চলতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম ও ঢাকা ইডিজেডের বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫টি কারখানা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি গার্মেন্টসে শ্রমিকদের অসন্তোষের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি কারখানা আবার চালু হলেও কয়েকটি এখনও বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, কেউ আন্দোলনের মুখে, কোথাও কোথাও আন্দোলনের আশঙ্কায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া বায়ারদের আপত্তি, অর্ডার বাতিল, এলসি খুলতে না পারা, ভবিষ্যৎ সংকটের কারণে কিছু কোম্পানি বন্ধের দিকে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি সকালে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামোতে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে টঙ্গীরের বিসিক এলাকায় সুমি অ্যাপারেলস লিমিটেড ও দিশারী ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড নামের দুটি কারখানায় শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা দেয়। এ ঘটনায় আন্দোলন বন্ধে কারখানার পার্শ্ববর্তী ত্রিভলি অ্যাপারেলস লিমিটেড, জিন্স অ্যান্ড পোলো, রেডিসন গার্মেন্টস লিমিটেড, আরবিএস ফ্যাশন অ্যাপারেলস লিমিটেড, বেলিসিমা অ্যাপারেলস লিমিটেড ও প্যাট্রিয়ট ইকো গার্মেন্টস লিমিটেডে ছুটি ঘোষণা করা হয়। মূলত সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের দাবিতে এসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেছে।
১৩ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে এবং গ্রেডের সংখ্যা সাত থেকে কমিয়ে পাঁচে নামিয়ে একটি গেজেট জারি করে। যা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। সে অনুযায়ী জানুয়ারিতে নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের মজুরি ও ভাতা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে গার্মেন্টসের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সে অনুযায়ী কাজ করতে নারাজ হওয়ায় নতুন আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, আসলে আমরা মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছি। এটি বোর্ড দ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব কল কারখানার। তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা তা মীমাংসা করছেন। দুদিন আগেও আলোচনা হয়েছিল। নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কেন নির্ধারিত মজুরি দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন, গেজেট প্রকাশের পর এ বিষয়ে আপত্তি করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই আপত্তি করেছেন। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। ১০,৪০০। আমরা ১২ হাজার ৫০০ টাকা করেছি। শ্রমিকরাও আপত্তি জানায়। তাদের দাবি ছিল আরও বেশি। এখন কারখানা কর্তৃপক্ষ আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যুক্তিসঙ্গত হারে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার শিউলী বলেন, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। এখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। বর্তমান বাজারমূল্য বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও অপুষ্টিতে ভুগছে। সেখানে পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই সামান্য বেতনে সংসার চালানো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা শ্রমিকদের বলছি, যেসব কোম্পানি ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করছে না; তাদের তালিকা করতে। আমরা তাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসব।
মরিয়ম আক্তার বলেন, আমরা চাই না শ্রমিকরা আবার আন্দোলন করুক। হামলা ও ভাংচুর হোক । কিন্তু অধিকার আদায়ে আন্দোলন ছাড়া উপায় নেই।
চলমান আন্দোলনের কারখানা সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় মালিকরা ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে রাজি না হলে আপনার ব্যবস্থা কী হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকাশিত ন্যূনতম মজুরি না মানার সুযোগ নেই। গেজেটে আলোচনা করে কমানোর সুযোগ নেই। তবে এটাও সত্য যে সব প্রতিষ্ঠানই নির্দিষ্ট মজুরি দিতে সক্ষম নয়। কিছু ছোট ছোট স্থানীয় প্রতিষ্ঠান আছে যারা নির্ধারিত মজুরি দিতে পারেনি। সেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে সরকার যেন তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করা বা তাদের পাওনা পরিশোধ করা ছাড়া আপোষের কোনো সুযোগ নেই।
মরিয়ম আক্তার আরও বলেন, কিছু বড় কোম্পানি বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নেয় আবার কখনো ছোট কোম্পানি থেকে কাজ করে। সেক্ষেত্রে, তারা ক্রেতাদের দেওয়া মূল্য গ্রহণ করে, কিন্তু চালান সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তা দেয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা কারখানাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি; এটা হওয়া উচিত নয়। ক্রেতার অর্ডার আউটসোর্স করা হলে মালিক প্রাপ্য মূল্য পায় এবং পণ্য উৎপাদনকারী শ্রমিকরা লাভবান হয়।
বিদেশি নিষেধাজ্ঞার হুমকি শ্রম খাতে প্রভাব ফেলছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আশা করি পোশাক খাতে এমন কিছু হবে না। কারণ এটি আমাদের দেশের রপ্তানি খাতের আয়ের প্রধান উৎস। এতে লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন জড়িত। তারপরও দেখা যায় অনেক পোশাক ক্রেতা অর্ডারকৃত পণ্যের এলসি খুলতে পারছেন না, কিছু ক্রেতা নিজেরাই এলসি খুলতে সময় নিচ্ছেন। যার কারণে কিছু পোশাক সংকটে পড়ছে। এ কারণে কেউ কেউ তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে যাচ্ছেন। আমাদের জায়গা থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ, সরকার যেন সব কিছুর দিকে নজর রাখে। মালিকদের কোনো অসুবিধা হলে বিশেষ করে কম ক্ষমতাসম্পন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে।