দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফা ও ব্যয়বহুল: টিআইবি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে একতরফা ও মিথ্যা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশুভ লক্ষণ।
আজ রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
টিআইবির মতে, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শতভাগ প্রার্থী অন্তত একবার আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। অন্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও খুব পিছিয়ে ছিলেন না এই প্রতিযোগিতা থেকে৷ প্রার্থীদের ৯৮ শতাংশই মানেননি নির্বাচনে ন্যূনতম ২৫ লাখ টাকার ব্যয়সীমা৷
এই আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি দেশের ২৯৯ টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ৫০ টি নির্বাচনী এলাকার তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছে।
টিআইবির মতে, এই নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক অবক্ষয় এবং নির্বাচনী কৌশল ও উদ্ভাবনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক টেস্ট কেস হিসেবে বিবেচিত হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল বাস্তবায়নের একতরফা নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আইনি বৈধতা নিয়ে হয়তো কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, তবে সাফল্য চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে রাজনৈতিক সততা, গণতন্ত্র এবং নৈতিকতার মানদণ্ড।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সমান প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত পূরণ হয়নি।
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, নির্বাচনে প্রার্থীরা গড়ে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা ব্যয় করেছেন, যা ব্যয় সীমার ছয় গুণ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সবচেয়ে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে সংস্থাটি দাবি করেছে, এই নির্বাচন আয়োজনে দুই হাজার ২৭৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০১৮ সালে এই ব্যয় ছিল৭০০ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ছিল ৩০০ কোটি টাকা এবং ২০০৮ সালে ছিল ২০০ কোটি টাকা।
নির্বাচনী সরকার ইস্যুতে প্রধান দুই দলের পরস্পরবিরোধী ও অস্থির অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন হয়নি বলে মনে করছে টিআইবি। সংগঠনটির মতে, প্রতিক্রিয়াশীল ও অসামাজিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের সংগ্রামে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।
টিআইবির মতে, নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনী এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রশাসন একই এজেন্ডার সহায়ক ভূমিকায় একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
টিআইবি বিশ্বাস করে যে, সততা ও নীতি-নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের আস্থা ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন এবং এর প্রভাব সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের সম্ভাব্য সাফল্য বা ব্যর্থতার যেকোনো স্বার্থের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। দেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আরও গভীর হতে থাকবে
একটি ‘নির্বাচন’কে এমন একটি নির্বাচন বলা যেতে পারে যেটিতে ভোটারদের পছন্দ করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক বিকল্প নেই তা নিয়েও গুরুতর সন্দেহ রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে কোনো কোনো আসনে ব্যালট পেপারে ১০-১১ জন প্রার্থীর নাম ও প্রতীক থাকতে পারে, কিন্তু চমকপ্রদ বাস্তবতা হলো, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের লোক। কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগের মনোনীত, কেউ স্বতন্ত্র, কেউ বিদ্রোহী, কেউ ডামি। তারা সবাই সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। আর আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য দলের সব প্রার্থীও আওয়ামী লীগের শরিক, সহযোগী বা অনুগত। ফলে ওই ব্যালট পেপারে যেই প্রতীকের স্ট্যাম্প লাগানো হোক না কেন, তা কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের পকেটে যাবে। যেখানে একটি দল ছাড়া সরকার গঠনের সুযোগ নেই সেখানে এটাকে ভোট প্রক্রিয়ায় নির্বাচন বলার সুযোগ কোথায়?
তারপরও নির্বাচন এক হয়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে বরাবরের মতো আবারো ক্ষমতায় বসলো আওয়ামী লীগ। নতুন মন্ত্রিসভাও গঠন করা হয়েছে। এখন এই নতুন মন্ত্রী, এমপি, সংসদ, সরকার- এদের যতই অবৈধ বলুন বা অপছন্দ করুন না কেন, বাস্তবতার খুব একটা পরিবর্তন হবে না। আপনি তাদের বিরক্ত করতে পারেন, কিন্তু আপনি তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবেন না। এই সরকারকে মেনে নিতে হবে। আপনি যেতে যেতে পরিবর্তন সম্পর্কে চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারেন , কিন্তু যতক্ষণ না আপনি পরিবর্তন করতে পারেন, জোর যাত্রা চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু এই প্রশ্নটি মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। যারা মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন তারা ভালো করেই জানেন যে, জনগণ নয়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অনুগ্রহ তাদের পেছনে কাজ করেছে। এটা শুধু আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপিদের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত এমপিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা এটাও জানে যে শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ের হাত তাদের মাথায় না থাকলে তাদের পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব হতো না। জাতীয় পার্টির ১১ জন সাংসদ হোক, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ ইব্রাহিম হোক বা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন—এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। এই ঘটনার আগে সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম কি কখনো স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন? তাও নিজের এলাকার বাইরে, আলাদা অন্য এলাকা থেকে? তিনি কি ভেবেছিলেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি করছেন, কথা বলছেন, ওই দলের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে প্রচারণা চালাবেন? আর এসব হয়েছে শেখ হাসিনার জন্যই । ফলে এই ইব্রাহিমদের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে? জনগণের কাছে নাকি শেখ হাসিনার কাছে? ।