ডলারের উপর চাপ বাড়ছেই বাড়ছে
বাজারে নির্ধারিত দামে মিলছে না ডলার। নতুন বছরও শুরু হলো সংকট নিয়ে। ডলার বিনিময় হার এবং মূল্য সম্পর্কে সবব্যাংকিং খাত এখন অস্থিতিশীল। কোথাও পাওয়া গেলেও সীমিত পরিমাণ ডলারের দামে কিনতে হবে। আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় উদ্বিগ্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে সংকট মেটাতে প্রতিদিনই বাজারে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ ক্রমাগত কমছেই। এদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। নতুন বছরে এই চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যও কমেছে। ডলার সংকটের কারণে আসন্ন রমজান মাসে ৮টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, ২০২২ সালের মার্চে শুরু হওয়া ডলার সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত বছর ভয়াবহ আকার নেয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানিকারকরা তাদের দাবিকৃত ডলার পাননি। রপ্তানিকারকরাও ন্যায্য দাম পাননি। ৮৫ টাকার একটি ডলার খোলা বাজারে বিক্রি হয় ১২৮ টাকায়। ২০২৩ সালের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ১০৩ টাকা। বছর শেষে ডলারের সরকারি দাম দাঁড়ায় ১১০ টাকা। যদিও ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম বাড়ছে আমদানি পর্যায়ে ১২২-১২৩ টাকায়। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
এদিকে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নানামুখী তৎপরতা চালালেও বাস্তবে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। গত বছরজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখতে চাপে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। IMF ঋণের শর্ত ছিল ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ কমপক্ষে $২৫.৩২ বিলিয়ন নেট রিজার্ভ থাকতে হবে। সেটাও সম্ভব ছিল না। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সারা বছর প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়। এটির এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি নেট রিজার্ভ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকটের অন্যতম কারণ মানি লন্ডারিং। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি জানায়, রপ্তানির একটি বড় অংশ দেশে প্রবেশ করে না। একইভাবে পাচার হচ্ছে প্রচুর ডলার। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী অবৈধভাবে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে দেশের বাইরে সম্পদ গড়ে তুলছে।
বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বাড়ছে অস্বস্তি: দুই বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। নতুন বছরেও এই চাপ অব্যাহত থাকবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৫১ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল $২.৬৭ বিলিয়ন, যা আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। মূলত চীন ও রাশিয়ার ঋণের কারণে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে জুলাই-নভেম্বর মাসে ২১১ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৩ মিলিয়ন ডলার কম।
সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের আমদানি বিলের জন্য বাংলাদেশ ১২৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী- গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি (২৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী BPM-৬ পদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবর সাথে ৫২৫ কোটি (৫.২৫ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ১৮ মিলিয়ন ডলার বা ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে, মোট রিজার্ভ ছিল $২৯.৭৩ বিলিয়ন এবং BPM-৬ অনুযায়ী $২৩.৩৭ বিলিয়ন।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নেট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব আছে, যেটি শুধুমাত্র আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকা উচিত।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হল বৈধ মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে আইনি মাধ্যমে ডলার আনার ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছর ২০২৩ সালে দেশে প্রবাসীদের আয় ছিল ২ হাজার ১৯০ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ১৩০ মিলিয়ন ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সংকটের কারণে বাজারে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি মাসে আকুর বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এসব কারণেই রিজার্ভ কমছে।