বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন একদলীয় শাসনের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে
বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন একদলীয় শাসনের ভীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা এক প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে। এর শিরোনাম‘ওয়ান-সাইডেড বাংলাদেশ ইলেকশন রেইজেজ অব ওয়ান পার্টি রুল’। কিছু পর্যবেক্ষক এই নির্বাচনকে ‘অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ’ বলে নিশ্চয়তা দেয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু দেশের কর্মকর্তারা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে গত রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কখনো কখনো তা হিংস্র হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নে হাজার হাজার সদস্যকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।হয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন একদল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান জিম বেটস। ভোটের সময় তিনি ঢাকার কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ভোটগ্রহণ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ভোটের প্রশংসা করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে জিম বেটস বলেন, আমি বলব এখন পর্যন্ত এটি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক ইমেল বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছেন যে মার্কিন সরকার ২০২৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি। যারা এ বিষয়ে কথা বলছেন তারা তার ব্যক্তিগত মতামত। এসব মন্তব্য তার বা তাদের ব্যক্তিগত মন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতামত নয়।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সাথে একমত যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হওয়ায় আমরা নিন্দা জানাই। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের সময় এবং তার আগের মাসগুলোতে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দা জানায়। ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অপরিহার্য। নির্বাচনকালীন সময়ে এই মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে পূরণ হয়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছেন, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে হাজার হাজার বিরোধী নেতা-কর্মীকে নির্বিচারে আটক বা ভয় দেখানো হয়েছে। এই কৌশলটি সত্যিকারের খাঁটি প্রক্রিয়ার জন্য উপযোগী নয়। তিনি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
পশ্চিমা গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নির্বাচনের ব্যাপক সমালোচনা করলেও চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ দ্রুত বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন একদলীয় শাসনের নায়ক শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রথমে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। তার জয়ের প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এক্স-এর একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি। টানা চতুর্থবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের জনগণকেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব ও সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিরোধী জোট নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা সেই দাবি নাকচ করে দিলে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। সরকারকে সহযোগিতা না করতে এবং নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া, পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার সংস্থা এবং এমনকি যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদের একটি অংশ এই সংখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই সন্দেহের অন্যতম কারণ ভোটারদের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন। নির্বাচন কমিশন সচিব বলেন, ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলেছে, চূড়ান্ত ভোট হয়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। বিরোধীরা বলছেন, ভোটগ্রহণের শেষ ঘণ্টায় অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের দাবি গুরুতর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যারা আওয়ামী লীগেরই নেতা, তারাই ২৮০ টি আসন পেয়েছে। ফলস্বরূপ, জাতীয় পরিষদের ৯৪ শতাংশ আসন ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের দ্বারা পূর্ণ। নির্বাচনে ২৭টি দল প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি দল একটি আসনও পায়নি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের স্থানীয় একটি টিভি স্টেশনকে বলেন, নির্বাচন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তার দল ১১টি আসন জিতেছে। তিনি আরও বলেন, সরকার যাকে চায়, তিনিই জিতেছেন। আমি মনে করি বাংলাদেশের এই একতরফা নির্বাচন কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে না।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ সম্প্রতি গ্লোবাল নিউজকে বলেন, , আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে এমন একটি বিরোধী দল বানাতে চাইছে পার্লামেন্টে যারা ক্ষমতাসীন দলকেই সমর্থন করেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দফায় বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতাকর্মীদের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে যে, নতুন সরকার বিএনপির মত সবচেয়ে বড় এবং কার্যত দলকে রাজনীতি তকেকে নিষিদ্ধ করতে পারে বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচন আর একদলীয় শাসন ।