ক্ষুধা পেলে মেজাজ কেন খারাপ হয়?
ক্ষুধা:
ক্ষুধা হল দুর্বলতা বা অস্বস্তির অনুভূতি যখন আপনার কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হয়। ক্ষুধা শরীরের একরকমের সংকেত যা আপনাকে খেতে হবে বলে তাগিদ দেয়।
ক্ষুধা’ শব্দটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম, প্রকৃত ও মৌলিক শব্দ বললে অত্যুক্তি হবে না। ক্ষুধা এমন একটি অনুভূতি যা কোন শব্দের সাথে মেলে না। রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য, আনন্দ সবই ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে মূল্যহীন। প্রেম, কবিতা বা আবেগের মতো অনুভূতি ক্ষুধার রাজ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রেমাস্পদের জগৎ-ভুলে যাওয়া হাসি কিংবা চোখের চাহনিও মনে হয় ছোট্ট একখান বিষাক্ত জঙ্গলের কাঁটা। । ক্ষুধা শেষ পর্যন্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। ধনশালীদের শখ করে দুএক বেলা না খেয়ে থাকা আর খাদ্যের অভাবে খেতে না পারা এক বিষয় নয়। ক্ষুধার জ্বালা যে বড় জ্বালা! একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খাবার ছাড়া আর কিছুই দেখে না, তার কাছে এই ধরণী একঘেয়ে গদ্যময় মনে হয় ।
সমস্ত মানুষের এমনকি সমস্ত জীবেরও সাধারণ ক্ষুধা হল প্রকৃত ক্ষুধা, যা খাদ্যের অভাব থেকে আসে। তখন পেট মোচড় দেয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, মাথা ঝিমঝিম করে, শরীরও কাঁপতে পারে।
শরীর আসলে একটি বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিন। গাড়ি বা কারখানার ইঞ্জিন চালাতে যেমন জ্বালানীর প্রয়োজন হয়, তেমনি শরীরেরও জ্বালানির প্রয়োজন হয়। আর সেই জ্বালানিই খাদ্য। শরীরকে সক্রিয় থাকার জন্য শক্তির প্রয়োজন এবং সেই শক্তি আসে খাবার থেকে।
ক্ষুধার অনুভূতি আসে পেটে থেকে নয়; মস্তিষ্কে থেকে প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত মানুষের অনুভূতি মস্তিষ্কে জন্মগ্রহণ করে। মস্তিষ্ক আপনাকে ঠিক কোথায় ব্যথা তা বলে দেয়। এর জন্য আমাদের স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস অ্যাক্টিভিটি একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু হল ভ্যাগাস নার্ভ। এর অন্যতম কাজ হল পাকস্থলী ও পুষ্টির দিকে নজর রাখা। এই স্নায়ু মস্তিষ্ককে বলে পেট কতটা খালি এবং আপনার পেটে কতটা খাবার আছে। মস্তিষ্ক তখন প্রয়োজন মতো ক্ষুধার অনুভূতি তৈরি করে।
ক্ষুধা ইংলিশ Hungry , আর রাগ ইংলিশ Angry , খিটখিটে মেজাজ বা ক্ষুধার কারণে রাগ আসলে তাকি বলি Hangry বলে। যেটি Hungry এবং Angry সংমিশ্রণ। এই শব্দটি নতুন এবং বৈজ্ঞানিক জগতেও সম্প্রতি ব্যবহৃত হয়েছে।
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন বা চর্বি যাই খাই না কেন, সেগুলি হজম হয় এবং গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ফ্যাটি অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। তারপর তারা রক্তের সাথে মিশে সমস্ত অঙ্গ এবং টিস্যুতে পৌঁছায়। ফলস্বরূপ, শরীর শক্তি উত্পাদন করতে পারে এবং কাজ করতে পারে।
আমরা সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়ার পরে ক্ষুধার্ত অনুভব করি। যখন আমাদের রক্ত আমাদের শরীরের শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে না তখন আমরা ক্ষুধার্ত থাকি। তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়। অর্থাৎ শরীরে শক্তির অভাব হয়। মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বেশি সক্রিয়। এবং মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করার জন্য গ্লুকোজের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
একটি খুব সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এটি সম্পর্কে চিন্তা করুন, আপনি যখন ক্ষুধার্ত কিছুতে ফোকাস করতে পারেন? আপনি যখন ক্ষুধার্ত থাকবেন তখন আপনি অজান্তেই সব ধরণের হাস্যকর অনর্থ ভুল করবেন। এছাড়াও তখন সামাজিকতা বা সামাজিক রীতিনীতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলস্বরূপ, আপনি অকারণে কাউকে চড় মারা বা রেগে যাওয়ার মতো কাজগুলি অনায়েসে করতে পারেন। যার জন্য পরে অনুতপ্ত হন।
এছাড়াও এই সময়ে মস্তিষ্ক থেকে বিভিন্ন অঙ্গে কিছু হরমোন নিঃসরণ করার জন্য সংকেত পাঠানো হয় যাতে তারা আরও গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই হরমোন উৎপাদনের ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিছুটা উত্তেজিত হয় এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধের অবস্থা তৈরি হয়। যার ফলে ক্ষোভ বা মারামারির মতো ঘটনা ঘটে।
একটানা দীর্ঘ সময় কাজ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বা দীর্ঘায়িত অনাহার এড়ানো উচিত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তীব্র ক্ষুধা অনুভব করার আগে হালকা কিছু খাওয়া ভালো। অন্যথায়, শরীরের চর্বি ভাঙতে শুরু করে। এতে শরীর ও মনে খারাপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিভিন্ন কারণে মানুষের মেজাজ ভালো বা খারাপ হতে পারে। মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হলে আবার স্বাভাবিক হয়। মেজাজ খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ হল ক্ষুধা। গবেষকরা বলছেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাপেল হিলের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছেন, ক্ষুধার কারণে মেজাজ পরিবর্তনের কারণ হতে পারে জটিল আবেগের তাড়না। যা বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং পরিবেশগত কারণের সাথে জড়িত।
গবেষণায় দেখা গেছে যে যখন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি তাদের নিজের অনুভূতির প্রতি সচেতন বা সতর্ক থাকে না, তখন তারা আরও নেতিবাচক আবেগ অনুভব করে যেমন চাপ, ঘৃণা ইত্যাদি।
নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক জেনিফার ম্যাককরম্যাক বলেন, মেজাজের ওপর ক্ষুধার প্রভাব এবং পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নতুন নয়। সর্বশেষ খবর হল ইংরেজি শব্দ ‘হ্যাংরি’, যার অর্থ হলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় মেজাজ খারাপ হওয়া, তা অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।”
এই গবেষণাটি ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর উপর করা হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের যার অর্থ হলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় মেজাজ খারাপ হওয়া, তা অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।”
এই ‘পরীক্ষাটি ‘ সতর্কতা ছাড়াই ক্র্যাশ করার জন্য এবং অংশগ্রহণকারীদের যাচাই করার জন্য সাজানো হহয়েছিল।
তারপরে তাদের একটি প্রশ্নোত্তর সেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তাদের প্রায় সকল পরীক্ষার্থীর সবারই মেজাজের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছিল।
গবেষণার লেখক ক্রিস্টেন লিন্ডকুইস্ট বলেছেন, “আমরা দেখেছি যে ক্ষুধার সময় মেজাজ খারাপ হয় তখনই যখন ক্ষুধার কারণে অস্বস্তির অনুভূতি হয় এবং তাদের চারপাশের ব্যক্তি বা পরিবেশ সেই অস্বস্তির কারণ হয়।”