আদম (আ.) কে সিজদা না করতে ইবলিশকে ধোকা দিল কোন শয়তান?
এ সকল অবান্তর প্রশ্ন এখন বাজারে পাওয়া যায় যে, আদমকে সিজদা না করতে ইবলিশকে কোন শয়তান ধোঁকা দিয়েছিল? ওই সময় তো শয়তানের অস্তিত্বই ছিল না । ইবলিশে তো প্রথম শয়তান তাহলে এমনটি কেন হল?আদম (আ.) কে সিজদা না করতে ইবলিশকে ধোকা দিল কোন শয়তান? এটা বাস্তবে কোনো প্রশ্নই না। এটি সন্দেহবাদীদের (সংশয়বাদীদের) জন্য একটি ধোঁকা। তারপরেও যে আত্মার কুপ্রবৃত্তি এই প্রশ্নের উদ্রেক করে সেটাই এই প্রশ্নের জবাব । অর্থাৎ এটা হল আত্মা বা নফসের ধোঁকা । যেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
যেকেউ যে নফসের ধোঁকার শিকার হতে পারে তারা এই সহজ সত্যটি জানে না বা ইচ্ছা করে বোঝার চেষ্টা করেনা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানবজাতির পালনকর্তার কাছে, মানবজাতির প্রভুর কাছে, মানুষের মাবুদের কাছে- কুমন্ত্রণাদানকারী অনিষ্ট থেকে, যে গা ঢাকা দেয়। যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। জিনদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে।’ (সুরা নাস: ১-৬)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার শিরার চেয়েও কাছে।’ (সূরা আল কাফ :১৬)
আরও বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই নফস মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।” (সূরা ইউসুফ: ৫২)
তাই শয়তান যেমন কুমন্ত্রণা দিতে পারে তেমনি আত্মাও কুমন্ত্রণা দেয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (স) আত্মার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাইতে শিখিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে আল্লাহ! আমি আমার আত্মার অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্ট থেকে এবং তার শিরক (বা মিথ্যা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)
আত্মপ্রতারণার ভিত্তি হলো চিন্তা ও যুক্তি। এবং শয়তান, তার নিজের যৌক্তিক প্রতারণা দ্বারা, আদমকে সেজদা করা থেকে বিরত ছিল। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিয়েছিলাম তখন তোমাকে সেজদা করতে কিসে বাধা দিল’? সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে।’ (সূরা আরাফ: ১২)
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, ইবলিস জ্বীন জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর আল্লাহ মানুষ ও জিনকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। অর্থাৎ চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং বলেছেন পরকালে তাদের কর্ম অনুযায়ী বিচার করা হবে। হে মানুষ ও জ্বিন! অচিরেই তোমাদের (হিসাব নিকাশের) প্রতি মনোনিবেশ করব।’ (সুরা আর রহমান: ৭৮)
যেহেতু ইবলিস একটি জ্বীন সেহেতু সে নফসের প্রলোভনে এবং তার স্বাধীনতা প্রয়োগে অহংকারী হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ মাটির তৈরি মানুষের কাছে মাথা নত করা ঠিক হবে না বলে মনে করেছে সে । কিন্তু সে তার অহংকারী মনোভাবকে এমনভাবে প্রকাশ করেছিল যে সে নিজেই প্রভুর আদেশ অমান্য করেছিল।
আরও পড়ুন
হাদিসের আলোঃ সময় থাকতে নবীজি (সাঃ) যে ৫ টি বিষয়কে মূল্যায়ন করতে বলেছেন
মাহরাম কারা? তাদের পরিচয় জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্যই জরুরি
সবাইকে মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তাকে শ্রবণ ও দেখার ক্ষমতা দিয়েছি। আমি তাকে পথপ্রদর্শন করেছি, সম্ভবত সে কৃতজ্ঞ হবে অথবা সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সূরা দাহর: ২-৩) । নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই সৃষ্টির সেরা। তাদের পালনকর্তার কাছে তাদের পুরস্কার হচ্ছে চিরস্থায়ী জান্নাত; যাদের নিম্নভূমিতে নদী বয়ে যায়, তারা তাতে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা তার প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য যে তার পালনকর্তার প্রশংসা করে।’ (সূরা বাইয়্যিনা : ৭-৮)
ইবলিস আল্লাহ তায়ালার ব্যাপকতায় পূর্ণ উপলব্ধি ছিল। সে খুব ভালো করেই জানতো যে, সর্বশক্তিমান ও সম্মানিত আল্লাহর অস্তিত্ব কতটা বিশাল, তিনি কতটা শক্তিশালী এবং ইবলিসকে তাঁর তুলনায় কতটা দুর্বল, নিছক একটি প্রাণী। এমনকি আল্লাহ তার সাথে কথা বলেছেন। এত মর্যাদা থাকার পরও সব কিছু জেনেও সে শুধু অহংকার বশত আল্লাহর হুকুমকে ‘না’ বলেছিল। তার অহং তাকে অহংকারী করে তুলেছিল। যদিও গর্ব করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। সেদিন আল্লাহ তায়ালার সাথে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল তা পবিত্র কোরানে বর্ণিত হয়েছে-
ইবলিস; যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি তুমি অনুগত হতে পারলে না কেন? তুমি কি তখন অহংকার করছিলে, নাকি তুমি নিজেকে মহিমান্বিতদের একজন মনে করো?’ (সুরা সাদ: ৭৫)
আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি এমন কঠিন প্রশ্ন শোনার পর, ইবলিসের উচিত ছিল অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া এবং স্বীকার করা যে সে একটি বড় ভুল করেছে, কিন্তু তা না করে সে আল্লাহকে বোঝানোর অহংকার দেখিয়ে বললেন, ‘আমি তার চেয়ে বড়। তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে।’ (সূরা সাদ: ৭৬)
ইবলিস শুধু আল্লাহর সাথে তর্ক করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার কোনো অনুশোচনাও ছিল না। পৃথিবীতে নির্বাসিত হওয়ার পরেও, সে শপথ করল যে মানবজাতির সৃষ্টি নিয়ে আজ তার এই অবনমন,মানবজাতিকে শেষ অবধি বিভ্রান্ত করবেই । ইবলিসের এই মানসিকতাও কিছু মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। অনন্তকালের জন্য জাহান্নামে যেতে ইচ্ছুক, তারপরও মহান আল্লাহর কাছে মাথা নত করবেনা । আসলে ধ্বংস তাদের জন্যই ।
‘আল্লাহর সাথে শরীককারীদের ধ্বংস’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ: ৬) । “ধ্বংস হল তারা যারা অনুমান করে” (সূরা জারিয়াত: ১০) । এভাবে আল্লাহ অনেক জায়গায় ধ্বংসের কথা বলেছেন।
আল্লার কুরআন এবং রাসূলের হাদিস অকাট্য ভাবে নফসের ধোঁকার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনায়ন করেছে। তাই এ সকল প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নাই। আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন হাদিস মেনে নিজের আত্মাকে কন্ট্রোল করে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।