March 1, 2025
জুলাই বিপ্লবের নায়কদের নতুন দল “জাতীয় নাগরিক পার্টি” (এনসিপি) এর বলিষ্ঠ যাত্রা

জুলাই বিপ্লবের নায়কদের নতুন দল “জাতীয় নাগরিক পার্টি” (এনসিপি) এর বলিষ্ঠ যাত্রা

জুলাই বিপ্লবের নায়কদের নতুন দল “জাতীয় নাগরিক পার্টি” (এনসিপি) এর বলিষ্ঠ যাত্রা

জুলাই বিপ্লবের নায়কদের নতুন দল “জাতীয় নাগরিক পার্টি” (এনসিপি) এর বলিষ্ঠ যাত্রা

১৬ বছরের স্বৈরাচারের অকথ্য নির্যাতন, অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গুত্ববরণ, মানুষের সকল অধিকার তলানিতে পৌঁছানোর পর ছাত্র-জনতা জেগে ওঠে, আর তার নেতৃত্বে ছিলেন যে তরুণ নেতা,  বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, অন্যতম বিপ্লবী, পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পদে সবচেয়ে  কম বয়সি নেতা যিনি আন্দোলনের প্রথম সারি থেকে বিপ্লবের মাধ্যমে  ডাক দেন হাসিনা ডাউনের এক দফার। 

সেই এক দফার মাধ্যমে একনায়কতন্ত্রের জঘন্য খলনায়ক, নিরপরাধ মানুষের উপর অকথ্য  জুলুম নির্যাতনকারী,  দুনিয়ার সেরা বর্বর  বাংলাদেশী স্বৈরাচারী খুনি বেহায়া হাসিনার সরকারের কবর রচনা হয়। তিনিই সেই পুরো আন্দোলনের সিপাহসালার ছাত্র-জনতার প্রিয় মুখ  মোঃ নাহিদ ইসলাম। যিনি সরকারেও ছিলেন ছয় মাসের উপরে। এখন তিনি ছাত্র-জনতার নতুন আন্দোলনকে  বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনতার কাতারে নেমে আসেন। তার দিকে তাকিয়ে নতুন বাংলাদেশ।  আন্দোলনের নায়কদের দিকে তাকিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।  আর সেই বিপ্লবী মেধাবি নায়কদের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

নতুন  রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে। আখতার হোসেন দলের সদস্য সচিব। জুলাই বিদ্রোহে শহীদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মীম আখতার আজ, শুক্রবার জাতীয় নাগরিক পার্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই দুজনের নাম ঘোষণা করেন।

আজ সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে নাগরিক পার্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম ঘোষণার পর আখতার হোসেন দলের আংশিক সাংগঠনিক বিবরণী পড়ে শোনান। কমিটিতে মোট ১৭১টি পদ রয়েছে।

আখতার হোসেন জানান, নতুন দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন সামান্থা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদিব। ডা: তাসনিম জারা ও নাহিদা সরওয়ার নিভা হলেন  সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব। হাসনাত আবদুল্লাহ হলেন প্রধান সংগঠক (দক্ষিণ অঞ্চল) এবং সরজিস আলম হলেন প্রধান সংগঠক (উত্তর অঞ্চল)। আখতার হোসেন আরও বলেন, নতুন দলের প্রধান সমন্বয়কারী হবেন নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, আর সিনিয়র যুগ্ম প্রধান সমন্বয়কারী হবেন আব্দুল হান্নান মাসুদ। পরে তিনি দলের যুগ্ম আহ্বায়ক, যুগ্ম সদস্য সচিব এবং যুগ্ম প্রধান সংগঠকদের নাম ঘোষণা করেন।

জুলাই  গণঅভ্যুত্থান নতুন স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। তরুণরা নতুন রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছে। এর জন্য সুসংগঠিত রাজনীতির প্রয়োজন। জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে এত দিন ধরে প্রস্তুতি চলছিল। অবশেষে, শুক্রবার, জুলাই মাসের  বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের নতুন দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে।

দলের আহ্বায়ক মোঃ নাহিদ ইসলাম বলেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম লক্ষ্য। তিনি দলীয় ইশতেহার পাঠ করে এই নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা করেন। নাহিদ জোর দিয়ে বলেন যে, জনগণের অধিকারের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে দলটি ঘোষণা করছি, তিনি বলেন,

‘বাংলাদেশে ভারত বা পাকিস্তানপন্থী কোনো রাজনীতি হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নির্মাণ করব।’

এনসিপির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদের পাশে পূর্বমুখী একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের জন্য মঞ্চের সামনে দুই হাজার চেয়ার রাখা হয়। গতকাল সকাল থেকেই জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন। শুক্রবারের নামাজের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মিছিল সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করে।

বিকাল ৩টা পর্যন্ত তারা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অবস্থান নেন। সময়ের নেতাকর্মীদের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের অবস্থান খেজুর বাগান মোড়ে পৌঁছায়। মিছিলে আসা বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন তরুণ-তরুণী। তবে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলাদেরও দেখা গেছে। কিছু মিছিলে ঘোড়ার গাড়ি এবং বাদ্যযন্ত্রের দলও দেখা গেছে। জনসভায় আসা পুরুষ ও মহিলাদের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক দুটি ভ্রাম্যমাণ টয়লেট এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

গতকাল বিকেল ৪:১৫ মিনিটে দলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক পাঠ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। এরপর জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য রাখেন। মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে বক্তব্য শুরু করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান ‘তুমি কে  , আমি কে  , বিকল্প, বিকল্প’ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিকল্পের জায়গা থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।

বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সেই ষড়যন্ত্র জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সবার ঐক্যের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি। আজকের মঞ্চ থেকে শপথ—বাংলাদেশকে আর কখনো বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।’

পরে, আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের ইশতেহার উপস্থাপন করেন। এতে তিনি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক একনায়কত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করাই হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।’

সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, নতুন নেতৃত্ব জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদের বিচার করতে সক্ষম হবে, ‘৫৪ বছর পর আমরা সেই সুযোগ পেয়েছি। একটি নতুন সংবিধানের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তরুণেরা স্বপ্ন দেখে, আগামীর বাংলাদেশ নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানাই।’

অন্যতম বিপ্লবী সামান্তা শারমিন বলেন, ‘বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরে আমাদেরকে একটি বাইনারি রাজনীতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা বলছি। জুলাই অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে এই উদ্যোগ আমাদেরকে নিতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো কোনো রাজনৈতিক দল এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই। এ দেশের মানুষ দুর্নীতিবিরোধী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজমুক্ত একটি সমাজ চায়। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলবে—এমন একটি রাজনৈতিক দল চায়।’

পরিচিত নেতা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যখন মুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন, আমরা তখন আমাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি বলতে চাই, তরুণেরা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন।’

ছাত্র বিপ্লবের অন্যতম কর্ণধার হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের মধ্য দিয়ে আমরা দুঃশাসনের কবর রচনা করেছি। সংসদে কে যাবেন, তা নির্ধারণ করবে দেশের খেটে খাওয়া জনতা। ক্ষমতার মসনদে কে বসবেন, তা নির্ধারণ করবে এই ভূখণ্ডের মানুষ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আমরা সচল করে গড়ে তুলব। বিভাজনের পরিবর্তে একতার রাজনীতি গড়ে তুলব। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের অকুতোভয়ের মিথস্ক্রিয়ায় আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব। কামার বা কুমারের ছেলে যোগ্যতার ভিত্তিতে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।’

সবার জন্যপ্রিয় আন্দোলনের প্রথম এবং প্রধান সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘যারা বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয়, তাহলে আবার একটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা দেশ এবং জাতিকে সবার ওপরে রেখে যেন নতুন ও সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করতে পারি।’

দৃঢ়চেতা মিষ্টভাষী নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। তরুণদের নেতৃত্বে দলদাসমুক্ত বাংলাদেশ। আর কখনো নির্বাচনের আগে ও পরে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না। দলমত-নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে বসবাস করার সুযোগ পাবে’।

জুলাই মাসে শহীদ  ছয়  বছর বয়সী জাবির ইব্রাহিমের বাবা নওশের আলী আশা প্রকাশ করে বলেন, যারা তাদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে তাদের উপর আর রক্তপাত হবে না। ‘এ দেশে ১৯৭১, নব্বই আর এই চব্বিশে রক্তক্ষরণ হয়েছে, জুলাই বিপ্লবের পর সে রক্তক্ষরণ আমরা চাই না। আমি চাই, আমার দেশ যেন এই দলের কাছে নিরাপদ থাকে।’

এদিকে, এনসিপির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও, ঢাকায় নিযুক্ত ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূত কেভিন এস. র‍্যান্ডাল এবং পাকিস্তান হাইকমিশনের কাউন্সেলর কামরান ধাঙ্গাল সহ কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।

আরো পড়তে

Leave a Reply

Your email address will not be published.

X