রাজনৈতিক ট্যাগে নির্যাতনের শিকার ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী
তাবৎ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জালিম ফ্যাসিস্ট হাসিনার ছাত্রলীগ দ্বারা গত ১৫ বছরে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং হলগুলিতে হয়রানির ঘটনাগুলির ৮৪ শতাংশ ছাত্রদেরই রাজনৈতিক ট্যাগ ব্যবহার করে হয়রানি করা হয়েছে। হলগুলোতে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী হয়েছে। নির্যাতিত
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিতদের ৮০ শতাংশই সাধারণ ছাত্র, যাদেরকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী সন্দেহে নির্যাতন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ক্যাম্পাসে নির্যাতন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ”সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’ পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (৭ অক্টোবর) অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘জুম’-এ আয়োজিত ওয়েবিনারে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এ ছাড়া ছাত্র শিবিরের কারণে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য রাজনীতির কারণে ২ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করা, রাতে অতিথি কক্ষের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকা, সিনিয়র নেতাদের যথাযথ সম্মান না দেখানোসহ নানা কারণে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ”সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’ এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিত ৫০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি।
সোমবার রাতে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ওয়েবিনারে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছে যে প্রায় ৮৪ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে, যেখানে ভিকটিমদের নির্দিষ্ট কক্ষে ডেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ১০ শতাংশ নির্যাতন ক্যাম্পাসের কোথাও শুরু হয়েছিল এবং একটি আবাসিক হলের একটি নির্দিষ্ট নির্যাতন কক্ষে শেষ হয়েছিল। ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অপব্যবহার শুরু হয় এবং শেষ হয় ক্যাম্পাসেই।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নির্যাতনের শিকার ২৬ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১৮ শতাংশ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ১৬ শতাংশ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে।
এটাও বলা হয় যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আগস্ট মাসটি সবচেয়ে সহিংস মাস।
নির্যাতনের রূপ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করা হয় এবং লাঠি, স্টাম্প, রামদা ও জিআই পাইপ দিয়ে আঘাত করা হয়। দলভিত্তিক নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে সিগারেট লাইটার, হকি স্টিক, ক্রিকেট স্টাম্প, লাঠি ও রড দিয়ে মারধর। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে, চড়, ঘুষি ও লাথি মেরে। কারো কারো নখ খুলে ফেলা হয়েছে। মাধরের পর পুলিশে সোপর্দ করে মিথ্যা মামলাও করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের কারণ, ধরন, সময় এবং নির্যাতন-পরবর্তী গতিবিধিও তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে অতীতের নির্যাতনের বিচার এবং ভবিষ্যতে নির্যাতন বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে ১০ দফা সুপারিশ করেছেন সোছার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো এবং ‘সোচ্চার সভাপতি শিব্বির আহমদ বলেন, “হয়রানির ঘটনার আগের দিন ও পরের দিনগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য এক নয়। ভিকটিমরা দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তির শিকার হয়। কারাবাস, মানসিক যন্ত্রণা, অনিয়মিত পড়াশোনা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আর্থিক ক্ষতি, ক্যাম্পাসে ভয় ও অনিশ্চয়তা।
তিনি আরও বলেন, ‘এসব নির্যাতন বন্ধ করে তদন্ত করতে সরকারি কমিশন গঠন করতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক তদন্ত কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভিকটিম সাপোর্ট সেল গঠন, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নিয়ম প্রণয়ন, ছাত্র রাজনীতির সংস্কার, হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্যাম্পাস সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, আবাসন সংকট সমাধান এবং ক্যাম্পাস সহিংসতা ৭ই অক্টোবরকে প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা। ।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, “ছাত্র নির্যাতনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে ও পরে। এর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। আশির দশকে ছাত্র-সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছরের ঘটনাকে ছাত্রসংঘর্ষ বলা যায় না, আমরা দেখেছি এখানে ছাত্র সংগঠন ও সরকার মিলে নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে। যার ভিত্তি ছিল বিচারহীনতা এসব বন্ধ করতে হলে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ।
আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, “শুধু আবরার ফাহাদ নয়, সারাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অনেক ভয়ংকর ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর যথাযথ ডকুমেন্টেশন ও বিচার জরুরি। না হলে এসব ঘটনা আবার ফিরে আসবে।”
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সোচ্চার গবেষণা প্রতিবেদন, নির্যাতনের বিচার এবং ক্যাম্পাসে নির্যাতন বন্ধে সোচ্চার সুপারিশসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন আলোচকরা। তারা বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যাতে ভয়মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ পারে সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতিমালা খুবই জরুরি।