মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
সেই সময় এসেও গেছে। মঞ্চও প্রস্তুত। এখন ভোটের পালা। নির্বাচনে কে জয়ী হবেন এবং সংসদ সদস্য (এমপি) হবেন সে সিদ্ধান্তের দিন আজ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি মাঠে নেই। ফলে নির্বাচনের ঐতিহ্যবাহী উৎসবের রং অনেকটাই কলঙ্কিত। তা সত্ত্বেও শতাধিক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাধান্য থাকায় আজকের নির্বাচন নিয়ে রয়েছে উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন প্রায় নিশ্চিত হলেও বিরোধী দল কারা হবে তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।
গত শনিবার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে বিএনপিসহ বয়কটকারী দলগুলো। এ কারণে বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে হামলা ও নাশকতার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হরতালের আগে শুক্রবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রেন ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে রাজধানীতে যানজট ও সাধারণ মানুষের চলাচল অনেকটাই কমে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালকে আগামী বুধবার পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখতে এবং যেকোনো ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
গত দুদিনে অনেক জায়গায় ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে অনেক জায়গায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা-মামলাও হয়েছে গতকাল। বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রশাসনের বিরুদ্ধে পোলিং এজেন্টদের হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন। যদিও এসব প্রার্থীর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় নেতা। নির্বাচন বিশ্লেষকরা অবশ্য ইতিমধ্যেই নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আজকের নির্বাচন নিয়ে গত কয়েকদিনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধেও এর প্রতিফলন ঘটেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলেছে, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করবে। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে নিজ দলের স্থানীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামানোসহ নানা কৌশল নিয়েছে দলটি। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নির্বাচনকে উৎসবমুখর করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিগত প্রশ্নে মতানৈক্যের কারণে এবারের নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ২৮টি দল। ২৯৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৯৭১ জন প্রার্থী। তাই নির্বাচনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহণমূলক নয় তাও বলা যাবে না।
এর আগে বিকেলে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, বিরোধীরা ভোট বয়কট প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করা কঠিন হবে। এমন পরিস্থিতিতেও ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এবারকার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে দু’জন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
আউয়াল কমিশনের দেয়া সূত্র মতে , দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন।
নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি।
সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১ ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন। এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের ২ হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হবে ভোটের আগের দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশী পর্যবেক্ষক থাকছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
বুধবার বিকেল পর্যন্ত ১৮৬ জন পর্যবেক্ষক-সাংবাদিককে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যাদের মধ্যে ১২৭ জন পর্যবেক্ষক আর ৫৯ জন গণমাধ্যমকর্মী।
আরো কিছু বিদেশী পর্যবেক্ষকের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ২০০ বেশি হবে।
নির্ধারিত ফলাফলের এই নির্বাচনেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়ার জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) সর্বমোট ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সাথে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্র সমূহে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করবে।
নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন পুলিশ ও র্যাব সদস্য আইনশৃংখলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারাদেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একইসাথে মাঠে কাজ করছে বিজিবি’র বিশেষায়িত ফোর্স র্যাপিড এ্যকশন টিম (র্যাট)। এছাড়া বিজিবি’র কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবি’র অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা রাখে।
এই নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে। এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করেছে। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এ মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন তথ্যে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হবে।
আউয়াল কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দু’জন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ তিনজন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল থাকবে।
এই নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে ইসির স্টিকার যুক্ত মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনের আগের দিন মধ্যরাত থেকে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কিছু যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ক্যাব, পিক আপ, মাইক্রোবাস এবং ট্রাক।
তবে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিল করা হবেঃ
আইন প্রয়োগকারী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন এবং অনুমোদিত পর্যবেক্ষক; জরুরী সেবায় নিয়োজিত যানবাহন এবং ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা এবং অনুরূপ পণ্য এবং সংবাদপত্র বহনকারী সকল প্রকার যানবাহন; আত্মীয়দের জন্য বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত যানবাহন, বিমানবন্দর থেকে যাত্রী বা আত্মীয়দের তাদের বাসভবনে বা আত্মীয়দের বাসভবনে ফেরার জন্য (টিকিট বা অনুরূপ প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য) এবং দূরপাল্লার যাত্রী বহনকারী বা স্থানীয়ভাবে ভ্রমণকারী কোনো যানবাহন। দূরপাল্লার যাত্রী; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য , রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি এবং গাড়িতে স্টিকার প্রদর্শন সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টের জন্য 1টি গাড়ি (জীপ, গাড়ি, মাইক্রোবাস ইত্যাদি ছোট আকারের যান); রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন সাপেক্ষে জরুরি কাজে ব্যবহৃত সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা মোটর সাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া; নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি প্রদান; জাতীয় মহাসড়ক ছাড়াও বন্দর, আন্তঃজেলা বা আন্তঃজেলা বা মেট্রোপলিটন সড়ক, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মহাসড়কের সংযোগ সড়ক এবং প্রধান প্রধান সড়ক বা এ জাতীয় সকল সড়কে বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; এবং স্থানীয় প্রয়োজনীয়তা এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা নির্দিষ্ট যানবাহনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ বা শিথিল করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।