টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন সেবা
অপারদর্শী এবং অপরিণামর্শী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিণতিতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম পাঁচটি শরীয় ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের । অর্থ সংকটের কারণে দেশের পাঁচটি শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকের আর্থিক লেনদেন সেবা বন্ধের মুখে রয়েছে। এসব ব্যাংককে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের অবস্থা নেতিবাচক। এ বিষয়ে বারবার অবহিত করেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকগুলো। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি হিসাবের ঋণাত্মক ব্যালেন্স সমন্বয়ের জন্য ২০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে যে যদি ২০ দিনের মধ্যে ঋণাত্মক চলতি অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স সমন্বয় করা না হয়, তবে ব্যাংকগুলি ক্লিয়ারিং বা নিষ্পত্তি ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকবে। যেসব ব্যাংককে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গত ২৮ নভেম্বর পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব ব্যাংককে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের অবস্থা নাজুক । এ বিষয়ে বারবার অবহিত করেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকগুলো। তাই ঋণাত্মক চলতি হিসাবের ব্যালেন্স সমন্বয়ের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ২০ দিনের মধ্যে ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত টাকা না রাখলে লেনদেন বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নিয়ম অনুসারে, বিভিন্ন ক্লিয়ারিং পেমেন্ট সিস্টেমের জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে বর্তমান হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রাখতে হবে। কিন্তু এই ৫টি ব্যাংকের চলতি হিসাব গত এক বছর ধরে ঘাটতিতে রয়েছে। গত ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পাঁচটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছে চিঠি দিয়ে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে অর্থের ঘাটতি পূরণের নির্দেশ দেয়।
এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের।
চিঠিতে বলা হয়েছে যে আপনার বর্তমান অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের পর্যালোচনা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘাটতিতে রয়েছে এবং সাধারণ ব্যাঙ্কিং অনুশীলনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি নিয়ে আপনাকে বারবার সতর্ক করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এতে আরও বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থ ঘাটতি সমন্বয় করা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে সব ধরনের বা নির্দিষ্ট ক্লিয়ারিং প্ল্যাটফর্মের লেনদেন থেকে নিষিদ্ধ করা হবে।
চিঠির বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এমডি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাতীয় ক্লিয়ারিং সিস্টেম থেকে ব্যাংকগুলোকে নিষিদ্ধ করলে তারা অবৈধ হয়ে যাবে। কারণ তারা কোনো আন্তঃব্যাংক লেনদেন করতে পারে না।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চলতি হিসাবে টাকা উদ্বৃত্ত আছে। । এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মেয়ে মায়মুনা খানম গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। টাকার ঘাটতি মেটাতে বন্ড কেনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সার্বিক ব্যাংকিং খাতে সংকট রয়েছে , তাই আমরাও সংকটে আছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মাজবাউল হক সরাসরি কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৭২ এর ধারা ৩৬(১) অনুসারে, আমানতকারীদের সুরক্ষার জন্য প্রতিটি ব্যাংকের মোট কল এবং মেয়াদী আমানতের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করতে হবে। বর্তমানে, এই হার প্রচলিত ব্যাংকগুলির জন্য ১৭ শতাংশ। আর সাড়ে নয় শতাংশ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের জন্য। ইসলামী ব্যাঙ্কগুলিকে সরকারী বিল এবং বন্ডগুলিতে বিনিয়োগের বিপরীতে ৫.৫ শতাংশ সহজে পরিবর্তনযোগ্য সম্পদ বা SLR এবং ৪ শতাংশ নগদ সংবিধিবদ্ধ নগদ রিজার্ভ বা CRR হিসাবে রাখতে হবে। যদি একটি ব্যাঙ্ক CRR বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় তবে অসুরক্ষিত অংশের উপর ৯ শতাংশ হারে পেনাল সুদ প্রদেয়। আর এসএলআর বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ৯.৭৫ শতাংশ জরিমানা করা হয়। যদি এ ব্যাপারে কোনো ব্যাংক একটানা ৪২ দিন ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশের ৩৬(৫)(ক) অনুযায়ী প্রত্যেক পরিচালককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করতে হবে। যাইহোক, বিধিবদ্ধ আমানত বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ৩৬ (৫)(খ) অনুযায়ী নতুন আমানত নেওয়া বন্ধ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এসব ব্যাংক অনেক দিন ধরে সিআরআর, এসএলআর রাখতে পারছে না। এসএলআরের জন্য এসব ব্যাংকের কাছে যেসব ট্রেজারি বিল ও বন্ড ছিল তা বন্ধক রেখে ধার করা টাকা খরচ করে ফেলেছে। নতুন করে ধার নেয়ার কোনো উপায় উপকরণ নেই। তারা কেবল আগে নেয়া ধারের মেয়াদ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তাদের আমানতের ৪ শতাংশ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট হিসেবে (CRR)হিসেবে রাখতে হয়। মূলত, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই বিধানের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়। উল্লেখিত পাঁচটি ব্যাংকের কোনোটিই নির্দিষ্ট হারে সিআরআর বজায় রাখতে সক্ষম নয়।