সামনে বাংলাদেশী নির্বাচনঃ ডলার রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা
আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রিজার্ভ ও ডলার নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে ডলারের সংকট চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন মুদ্রার সংকট তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে একঘেয়েমি স্বভাব সম্পন্ন পোদ্দাররের পরিচালনার দুর্বলতায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক কমছে। আবার রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও একেবারেই মন্থর। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। এ কারণে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ‘গ্রস’ রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর যদি আমরা IMF কর্তৃক গৃহীত BPM ৬ পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব করি, ২৩ নভেম্বর শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ রয়েছে ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভ যে স্তরে নেমেছে তা শুধু সমালোচনামূলকই নয় বরং ভয়ংকর উদ্বেগজনক।
ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো যেতে পারে। এটাও ধরে রাখা হয়েছে জোর করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। যেটা বাংলাদেশের বহু বছরের ইতিহাসে ঘটনা প্রথম ঘটনা । ডলারের বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। তারপর দাম কিছুটা বাড়বে এবং তারপর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তাহলে রিজার্ভ আবার বাড়বে। তাদের মতে, আইনি মাধ্যমে পুরো রেমিট্যান্স দেশে আসছে না। আবার টাকাও পাচার হচ্ছে। সরকার পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে যেমন সফল হয়নি, তেমনি পাচার বন্ধও করতে পারেনি। ফলে অর্থনীতিতে সংকট এখন বহুমুখী। তারা বলেছেন, এই সংকট শিগগির শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যদিও উচ্চপর্যয়ের সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলার সংকট শুরু হয়, যা এখনো চলছে। ২০২২সাল থেকে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য এবং পরিবহন খাতে খরচ বেড়েছে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। তবে সে তুলনায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়েনি। আমদানির জন্য ডলারের বর্ধিত চাহিদা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কারণ, প্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্যপণ্য, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়। এ ছাড়া দেশ থেকে অর্থ পাচারও ডলার সংকটের অন্যতম কারণ। এদিকে ডলার সংকটের কারণে গত দেড় বছর ধরে নানা চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সেই চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার সহায়তা দিচ্ছে। এতে দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকানো যাবে না,এবং যেটা হয়ে যাবে কঠিন কাজ । এ কারণে রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ক্ষমতার রিনিউ টাইপ নির্বাচনে বিশাল অংকের একটি অর্থনৈতিকযজ্ঞ পরিচালিত হবে ৭ই জানুয়ারি ।আর সেখানে হয়তোবা আন্তর্জাতিক ও দেশের টু-থার্ড মেজরিটি অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষের মানবিক ক্ষোভে কঠিন ভাবে নড়ে উঠতে পারে রিজার্ভ ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের রিজার্ভ বাড়াতে ডলার খুঁজছে। গত সোমবার ও মঙ্গলবার আর্থিক সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ৭০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। যদিও ডলারের ঘাটতি থাকায় বেশির ভাগ ব্যাংকই এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার ইসলামী ব্যাংক থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার এবং মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারে দুই মিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত ডলার থাকলে তাদের কাছ থেকে কিনব। এ ধরনের লেনদেন স্বাভাবিক। আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকে ২৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত বিপিএম ৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। সেদিন মোট রিজার্ভ ছিল২৫.১৬ বিলিয়ন ডলার । গত সপ্তাহে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় রিবাউন্ড ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) দায় বর্তমানে৫০ মিলিয়নে ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেখানে গত জুন পর্যন্ত আইএমএফের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার । এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং (এফসি) ১ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আইএমএফ এই দায়গুলো শেষ করতে বলেছে। ফলস্বরূপ, যদি এই দায়গুলি বাদ দেওয়া হয়, প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে সামান্য কম হয় । দেড় বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ কমতে থাকার এ প্রবণতা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনীতি কতটা চাপের মুখে পড়বে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা।
দেড় বছর ধরে চলমান ডলার সংকট এখনো কাটেনি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় কমে ৫.২৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এখনো ঋণপত্র খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না। আবার অনেক উদ্যোক্তাকে ঘোষিত মূল্যের চেয়ে ১২-১৩ টাকা বেশি দামে ডলার কিনতে হয়।
এদিকে, গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
যাইহোক, গত মাসে রেমিট্যান্স প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এদিকে চলতি মাসের ২৪ দিনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অক্টোবর মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১৯৭ মিলিয়ন ৭৬ মিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেডা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। সম্প্রতি ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থা দুটি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে সমর্থন করেছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিটেন্স কিনতে ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ ১১০ টাকা রপ্তানি আয়। আর আমদানি শুল্ক মেটাতে প্রতি ডলারে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে রেমিট্যান্সে সরকারের ২.৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও একই পরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে সুবিধাভোগীরা প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, বিদেশি সাহায্য যদি সেভাবে না আসে, নির্বাচন নিয়ে কোনো ইস্যু না হয়, তাহলে আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ব।