গাজা থেকে ফিরে আসা ইসরায়েলি সৈন্যদের মধ্যে ট্রমা এবং আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF)
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) হল ইসরায়েলের সামরিক সংগঠন, যার মধ্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভূখণ্ড জবরদখল করে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। IDF-এর মতবাদ সংখ্যাগতভাবে উন্নত প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা দ্বারা গঠিত, দ্রুত সংহতি এবং একটি শক্তিশালী রিজার্ভ ফোর্সের উপর জোর দেয়। ইহুদি পুরুষ ও মহিলাদের পাশাপাশি ড্রুজ এবং সার্কাসিয়ান পুরুষদের জন্য সামরিক পরিষেবা বাধ্যতামূলক, পুরুষদের জন্য ৩২ মাস এবং মহিলাদের জন্য ২৪ মাস, তারপরে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত রিজার্ভ ডিউটি। IDF তার উন্নত গোয়েন্দা ক্ষমতা এবং প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থার জন্য পরিচিত। এতে নাহাল ব্রিগেড, কেফির ব্রিগেড, কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পস এবং প্যারাট্রুপারদের মতো বিশেষায়িত ইউনিট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সায়েরেত মাতকাল হল IDF-এর মধ্যে একটি অভিজাত কমান্ডো ইউনিট, যা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের জন্য পরিচিত।
ইসরায়েলি সৈন্যরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে আসছে। গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, গত বছর যাদের হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গাজায় পাঠানো হয়েছিল তাদের অনেকেই বাড়ি ফিরে আত্মহত্যা করছেন।
৪০ বছর বয়সী এলিরান মিজরাহিকে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গাজায় পাঠানো হয়েছিল। এরপর, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এই রিজার্ভ সদস্য ‘অন্য ব্যক্তি’ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। তার পরিবার বলে যে, গাজায় লড়াই করার সময় মিজরাহি যা দেখেছিলেন তা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। যুদ্ধে যাওয়ার ছয় মাস পর, তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) তে ভুগছিলেন। যুদ্ধে ফেরত পাঠানোর আগে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার মা জেনি মিজরাহি বলেছেন যে, তিনি গাজা থেকে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু গাজা তাকে ছেড়ে যায়নি। পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে তিনি মারা গেছেন।
এদিকে, গাজা থেকে ফিরে আসার পর মানসিক রোগে ভুগছেন এমন এলিরান মিজরাহির মতো ইসরায়েলি সৈন্যরা ট্রমা-আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে যে PTSD বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হাজার হাজার সৈন্যের চিকিৎসা করা হচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছরে ইসরায়েলি হামলায় ৪২,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। জাতিসংঘের মতে, তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়া এই হামলায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইহুদি রাষ্ট্রটি এত বেশি প্রাণহানি দেখেনি।
গাজার যুদ্ধ এখন লেবাননে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক ইসরায়েলি সৈন্য এখন ভয় পাচ্ছে যে, তাদের আরেকটি যুদ্ধে ডাকা হতে পারে।
অন্যদিকে, চার মাস ধরে গাজায় দায়িত্ব পালন করা একজন IDF ডাক্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে CNN কে বলেন, “আমাদের অনেকেই ভীত। তারা মনে করে তাদের অন্যস্থানে যুদ্ধ করতে পাঠানো হতে পারে। আমাদের অনেকেই এই সময়ে সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছি না।”
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আইডিএফের তত্ত্বাবধানে বিরল পরিদর্শন ছাড়া বিদেশী সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয় না। এ কারণেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বা সেখানে ইসরায়েলি সৈন্যদের অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া কঠিন।
গাজায় যুদ্ধরত ইসরায়েলি সৈন্যরা সিএনএনকে বলেছে যে তারা এমন ভয়াবহতা দেখেছে যা বহির্বিশ্ব কখনই বুঝতে পারবে না।
তাদের কথা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর “চিরস্থায়ী যুদ্ধ” এর ভয়াবহ বর্বরতা এবং এর জন্য ইসরায়েলি সৈন্যরা যে অদৃশ্য মূল্য দিচ্ছে তা তুলে ধরেছে।
অনেক সৈন্যের জন্য, গাজার যুদ্ধ ইসরায়েলের অস্তিত্বের লড়াই এবং যেকোনো উপায়ে এটি জিততে হবে। কিন্তু যুদ্ধের মানসিক ক্ষতিও জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে। যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজের উপর যে, মানসিক ক্ষতি করছে তা বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সৈন্য, একজন ডাক্তার এবং নিহত রিজার্ভিস্ট মিজরাহির পরিবার তুলে ধরেছেন।
মিজরাহির বন্ধু এবং বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেন, গাজায় তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন। “আমরা খুব, খুব, খুব কঠিন জিনিস দেখেছি,” তিনি বলেন। “এটা মেনে নেওয়া কঠিন।”
প্রাক্তন সৈনিক গাজায় ইসরায়েলি সৈন্যদের মানসিক আঘাত সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। জুন’২৪ শে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জাকেন বলেছিলেন যে, সৈন্যদের মাঝে মাঝে “জীবিত বা মৃত শত শত মানুষের ” উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হত। তাদের সকলেরই রক্তাক্ত অবস্থা ছিল।
জাকেন আর মাংস খেতে পারেন না কারণ এটি তাকে গাজায় বুলডোজার থেকে দেখা ভয়াবহ দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার মাথায় বিস্ফোরণের শব্দের কারণে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয়।
মৃতদেহগুলিকে “মাংস” হিসাবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “যখন আপনি বাইরে এত মাংস এবং রক্ত দেখেন… আমাদের এবং তাদের (হামাস) এর, তারপর যখন আপনি (মাংস) খেতে বসেন, তখন সেই স্মৃতি সত্যিই আপনাকে কষ্ট দেয়।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন ডাক্তার বলেছেন যে, যখন সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের মুখোমুখি হয়, তখন অনেকেই নৈতিক কারণে এই ট্রমায় পড়ে যায়।
তিনি বলেন, যুদ্ধের শুরুতে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি এক ধরনের বৈরী মনোভাব ছিল। তাদের মধ্যে সাধারণ ধারণা ছিল যে, বেসামরিক নাগরিকসহ সকল গাজার মানুষ ‘খারাপ’ কারণ তারা হামাসকে সমর্থন করত, হামাসকে সাহায্য করত এবং তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখত।
তবে, অনেক সৈন্য বলেছেন যে, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের নিজের চোখে দেখার পর তাদের মনোভাব বদলে গেছে।
আইডিএফ দাবি করে যে, তারা গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ন্যূনতম রাখার জন্য ‘যা কিছু সম্ভব’ করছে। এ কারণেই তারা হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে টেক্সট বার্তা পাঠায়, ফোন করে এবং লিফলেট ফেলে।
তা সত্ত্বেও, গাজায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে; এমনকি সামরিক বাহিনী ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ আশ্রয় নেওয়ার পরেও মারা গেছে।
সিএনএন লিখেছে যে, সাহায্য কর্মী এবং জাতিসংঘ বারবার বেসামরিক নাগরিকদের উপর যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব তুলে ধরেছে। তাদের অনেকেই ১৭ বছরের অবরোধ এবং ইসরায়েলের সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের ফলে মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছেন।
জাতিসংঘ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, যুদ্ধের ভয়াবহতা গাজাবাসীদের এমন একটি মানসিক অসুস্থতায় ফেলেছে যা PTSD-এর প্রচলিত সংজ্ঞার সাথে খাপ খায় না।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ সামরিক তথ্য উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ২৪ এর ৭ অক্টোবর থেকে ১১ মে পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ জন সৈন্য আত্মহত্যা করেছে।
যুদ্ধের পর থেকে আইডিএফ-এ আত্মহত্যার সংখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে, আইডিএফ-এর কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের একজন মনোবিজ্ঞানী এবং কমান্ডার উজি বেচোর সিএনএনকে বলেন যে, মেডিকেল কর্পস পরিসংখ্যান প্রদানের জন্য অনুমোদিত নয় এবং সামরিক বাহিনী আত্মহত্যার হারে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখেনি।
যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেওয়া এক তৃতীয়াংশেরও বেশি সৈন্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ আগস্টে এক বিবৃতিতে বলেছে যে, প্রতি মাসে ১,০০০-এরও বেশি আহত সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার রিপোর্ট করা হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে, বছরের শেষ নাগাদ চিকিৎসার জন্য ভর্তি আহত সৈন্যের সংখ্যা ১৪,০০০-এ পৌঁছে , যার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়।
ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ৬,০০০ জনেরও বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে, এই ঘটনাগুলির প্রায় ২৩ শতাংশ সরকারের রেকর্ডে নথিভুক্ত নেই।
সামরিক তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে, টাইমস অফ ইসরায়েল জানিয়েছে যে ২০২১ সালে আইডিএফ-এর সৈন্যদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল আত্মহত্যা। সেই বছর কমপক্ষে ১১ জন সৈন্য আত্মহত্যা করেছিলেন।
কোনও পরিসংখ্যান না দিয়ে মন্ত্রণালয় বলেছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলির একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলে আত্মহত্যা কমেছে।
৭ অক্টোবরের হামলার এক বছর পূর্তিতে ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত একটি জরিপে দেখা গেছে যে মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন যে, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত, এমনকি যদি এর অর্থ “মানুষের জীবন বাঁচানো” হয়।