গাজা উপত্যকা পুরোটাই এখন অনিরাপদ
ইসরায়েলি হামলার মুখে দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় ফিলিস্তিনিরা উদ্বাস্তু হয়ে বেড়াচ্ছে।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নাসের হাসপাতালে ব্যাপক আহাজারি, চিৎকার আর চিৎকার। অ্যাম্বুলেন্স, ট্রাক, এমনকি গাধা টানা গাড়িও একের পর এক ছুটে চলেছে বাইরে মানুষের ছিন্নভিন্ন লাশ নিয়ে। কারো শরীরে প্রাণের স্পন্দন আছে, কারোর সম্পূর্ণ নিথর। এরই মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে একটি শিশু অনুনয় করে বলল, মাকে নিয়ে এসো।
সন্তানের মা আর ফিরে আসবে না। সোমবার রাতে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি স্কুলে ইসরায়েলি বোমা হামলায় তিনি নিহত হন। স্কুলে আশ্রয় নেওয়া আহতদের হাসপাতালে আনা হয়েছে। এ ধরনের হামলা ও রক্তপাতের চিত্র এখন পুরো গাজা জুড়ে। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়কারী লিন হেস্টিংস মঙ্গলবার বলেছেন, “গাজার কোথাও নিরাপদ নয়, গাজার জনগণের আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা বাকি আর নেই।”
গাজাবাসীদের সত্যিই কোথাও যাওয়ার নেই। ইসরায়েলের হুমকির মুখে তাদের উপত্যকার উত্তর থেকে দক্ষিণে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছিল। এবার দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে যেতে বলা হচ্ছে। এদিকে, সোমবার থেকে ইসরায়েলি বাহিনী উত্তরের পাশাপাশি দক্ষিণ গাজায়ও স্থল অভিযান শুরু করেছে। এছাড়া সংঘাতের শুরু থেকেই নির্বিচারে বিমান বোমাবর্ষণ চলছে।
গত বৃহস্পতিবার গাজায় সাত দিনের যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছে। কয়েকদিন পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দক্ষিণ গাজায় স্থল অভিযান শুরু করে। খান ইউনিসের বাসিন্দারা জানান, ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক প্রথমবারের মতো ওই এলাকার পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। এগুলো বনি সুহাইলা ও হামাদ সিটি এলাকায় অবস্থিত। ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র ইলন লেভি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছি। এই পদক্ষেপ কঠিন হতে যাচ্ছে।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় তাদের অভিযানকে পর্যায়ক্রমে ভাগ করেছে, কিন্তু বর্বরতা কখনো কমেনি। ৭ অক্টোবর সংঘাতের শুরু থেকে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ১৬০০০ লোক নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। একই সময়ে পশ্চিম তীরে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা আড়াই শত এর বেশি। এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের শুরুতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা গাজার বাসিন্দাদের শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরে বলেছে এখন সেখানে ‘কেয়ামত’-এর মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জাতিসংঘের জরুরী ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথের মতে, গাজা একটি রহস্যময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। আর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, গাজার যে এলাকা থেকে মানুষকে চলে যেতে বলা হয়েছে তা পুরো উপত্যকার এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
এদিকে, মঙ্গলবার কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সম্মেলনে দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ইসরাইলকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। এ বিষয়ে নীরব থাকার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়ী করেন। শেখ তামিম বলেছেন যে তার দেশ দুই পক্ষের মধ্যে একটি নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির দিকে কাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রও প্রতি মঙ্গলবার গাজার বাসিন্দাদের রক্ষার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, গাজার একটি এলাকাকে নিরাপদ ঘোষণা করার পর সেখানে যেন হামলা না হয় সে বিষয়টি ইসরায়েলের মনে রাখা উচিত।
তবে ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাই বলুক না কেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গতকাল স্পষ্ট করেছেন যে তারা উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ গাজায় বেশি সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করেছে; গাজা স্ট্রিপ ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের’ দিকে যাচ্ছে । ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অধিকৃত অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্ব সংস্থার প্রতিনিধি রিচার্ড পিপারকর্ন গতকাল মঙ্গলবার এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
পিপারকর্ন জেনেভা ভিত্তিক সাংবাদিকদের সাথে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে কথা বলেছেন। তিনি দক্ষিণ গাজা উপত্যকার রাফাহ এলাকা থেকে ভিডিও লিঙ্কে যোগ দেন। পেপারকর্ন বলেন, মধ্য ও দক্ষিণ গাজা থেকে মানুষের বাস্তুচ্যুতির হার নাটকীয়ভাবে বাড়ছে।
শুরুতে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলে হামলা চালালেও এখন তারা দক্ষিণাঞ্চলেও সেনা পাঠিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে বেসামরিক নাগরিকদেরও সরে যেতে বলা হয়েছে।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় গাজার পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলসহ চারদিকে ব্যাপক বোমা হামলা হচ্ছে।
WHO প্রতিনিধি সতর্ক করে বলেছেন, “গাজার পরিস্থিতি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের কাছাকাছি।” সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের কাছাকাছি রয়েছে।’
মুসলিমদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস বেষ্টিত পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের গাজার এই পরিস্থিতি সমাধানের জন্য এবং অবৈধ দখলদার ইসরাইলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য; সমগ্র দুনিয়ার মুসলিমদেরকে একসাথে প্রতিরোধের বিকল্প পথ নেই।