পেয়ারা: সুস্বাদ ও পুষ্টিগুণে অনন্য
মহান সৃষ্টিকর্তা যে সকল ফল মানুষের খাবারের জন্য দিয়েছেন সবগুলোই মানবজাতির জন্য এবং সৃষ্টির জন্য একটি অনন্য নিয়ামত। তার মধ্যে পেয়ারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ সস্তায় তামাম দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হল পেয়ারা। যেটা শুধুমাত্র বর্ষাকাল বা গুটি কয়েক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সারা দুনিয়াতে এখন এই পেয়ারা ফলটি খুব সহজলভ্য।
এক সময় পেয়ারা পাওয়া যেত শুধু বর্ষাকালে। ইয়াম্মি ও সুস্বাদু পেয়ারা এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়াও পেয়ারা ম্যাগনেসিয়াম, লাইকোপিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি চমৎকার উৎস। বিশেষ করে ভিটামিন ‘সি’ এর পরিমাণ এত বেশি যে আমলকি ছাড়া অন্য কোনো ফল থেকে এত ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায় না। তাহলে চলুন জেনে নিই পেয়ারার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে।
পেয়ারার পুষ্টিগুণ
এটি একটি পুষ্টিকর ফল। ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি। পেয়ারায় অন্যান্য সাইট্রাস ফল যেমন কমলালেবুর তুলনায় ৫ গুণ বেশি ভিটামিন-সি রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন রয়েছে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড এবং নিকোটিনিক অ্যাসিড রয়েছে। এছাড়াও পেয়ারাতে ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় রয়েছে ১৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি, ৭ গ্রাম ক্যালরি, ২৫০ আইইউ ভিটামিন-এ, ০.০৭ গ্রাম থায়ামিন, ১.২ মিলিগ্রাম নিয়াসিন, ৩০২ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি, ৩০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২৯ মিলিগ্রাম ফসরাস, কার্বোহাইড্রেট ১৭ মিলিগ্রাম। ১ গ্রাম, প্রোটিন থাকে ১ গ্রাম।
পেয়ারার স্বাস্থ্য উপকারিতা:
অনেকেই পেয়ারাকে সাধারণ ফল মনে করে খেতে চান না। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তারাও ফল খেতে উৎসাহিত হবেন এর পুষ্টিগুণ ও ঔষধি গুণাগুণ জানার পর। নিচে ফলের কিছু উপকারী দিক আলোচনা করা হল।
দাঁত ও মুখ গহ্বরের সমস্যার সমাধানে
দাঁতের ব্যথা? দাঁতে সংক্রমণ? মুখ গহ্বরের সমস্যা? একটি আধাপাকা বা কাঁচা পেয়ারা চিবিয়ে খেয়ে ফেলুন সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্ট পেয়ে যাবেন। যদি পেয়ারা না পান, পেয়ারা পাতা গরম পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ওই গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করুন। দাঁতের ব্যথা সহকারে দাঁতের অনেক সমস্যা ও মুখ গহ্বরের সমস্যার সমাধান পাবেন তাতে। এবং এটা পরীক্ষিত।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে
পেয়ারা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায়। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের যে কোনও জায়গায় কেটে গেলে ক্ষত শুকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট সুস্থ রাখে
গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত পেয়ারা খেলে রক্তচাপ ও রক্তের লিপিড কমে যায়। পেয়ারা পটাসিয়াম এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। পটাশিয়াম হৃদস্পন্দন এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। লাইকোপিন-সমৃদ্ধ গোলাপী পেয়ারার নিয়মিত সেবন কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পেয়ারার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে পেয়ারার রস এবং পেয়ারার পাতা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর কারণ এতে রয়েছে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্য।
ঠান্ডার সমস্যা দূর করতে
ব্রঙ্কাইটিসের মতো ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন সমস্যা সারাতে পেয়ারার ভূমিকা রয়েছে। ফলটিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং ভিটামিন সি থাকায় এটি শ্লেষ্মা কমায়। এছাড়া ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দূর করতে কাঁচা পেয়ারা কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
কাঁচা পেয়ারা ভিটামিন এ এর একটি ভালো উৎস। আর এই ভিটামিন এ চোখের জন্য উপকারী। এতে থাকা ভিটামিন এ কর্নিয়া সুস্থ রাখার পাশাপাশি রাতকানা রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পেয়ারা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
মাসিকের ব্যথা দ্রুত উপশম করতে
অনেক মহিলাই মাসিকের সময় পেটে ব্যথায় ভোগেন এবং ব্যথানাশক ওষুধ খান। এ সময় কেউ যদি পেয়ারা পাতা চিবিয়ে বা রস খান তাহলে তার মাসিকের ব্যথা দ্রুত কমে যায়।
থাইরয়েড গ্রন্থি সচল রাখতে
পেয়ারায় তামা সমৃদ্ধ ট্রেস উপাদান রয়েছে। তাই থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা ঠিক রাখতে পেয়ারা খুব ভালো অবদান রাখতে পারে। তাছাড়া এটি থাইরয়েড গ্রন্থির স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে, ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি কার্যকর থাকে।
শরীরের পেশী এবং স্নায়ু শিথিল রাখতে
পেয়ারা একটি ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ ফল। এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানটি শরীরকে আমাদের খাদ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি শোষণ করতে সাহায্য করে এবং শরীরের সমস্ত পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া পেয়ারা একটি ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ ফল যা আমাদের নার্ভাস আরাম প্রদানে ভূমিকা রাখে। এটি শরীরের পেশী এবং স্নায়ু শিথিল করতে সাহায্য করে। তাই কঠোর পরিশ্রমের পরে, পেয়ারা খাওয়া পেশী শিথিলকরণের পাশাপাশি কাজের সিস্টেমে একটি দুর্দান্ত শক্তি সরবরাহ করতে পারে।
পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে
পেয়ারা যেকোনো ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন বা পেট খারাপের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী এই ফলটিতে রয়েছে অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য যা পেটের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে
পেয়ারায় লাইকোপিন, ভিটামিন সি, কোয়ারসেটিনের মতো অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে। এটি প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেয়ারায় রয়েছে ভিটামিন এ। ফলে রাতকানা দূরে থাকে দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে করে তুলে। পেয়ারায় উপস্থিত ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
গর্ভাবস্থা, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার ২৪ সপ্তাহ পরে, একজন মহিলার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ অবস্থা। তবে পেয়ারায় উপস্থিত জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার প্রচুর পরিমাণে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে
পেয়ারায় রয়েছে ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি৯। যা শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক। ফলিক অ্যাসিড গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি স্পিনিয়া বিফিডার মতো নিউরাল টিউব ত্রুটি প্রতিরোধে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায় পুরো পাকা পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
জীবাণু এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে
ভিটামিন সি, ই, ক্যারোটিনয়েডস, আইসোফ্ল্যাভোনয়েড এবং পলিফেনলের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এটি জীবাণু এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং অসুস্থতা প্রতিরোধ করে।
মস্তিষ্ক শান্ত রাখে
গর্ভাবস্থায় কর্টিসলের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। যা আপনার অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পেয়ারা ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, যা স্নায়ু এবং পেশী শিথিল করে। ফলে ক্লান্তি মুক্ত হয় এবং মন শান্ত হয়।
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা নিরাময়ে সাহায্য করে
গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায়। পেয়ারায় রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন যা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
B3 এবং B6 এর একটি উল্লেখযোগ্য উৎস
এই দুটি ভিটামিনই পেয়ারায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান। B3 এবং B6 ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক। এছাড়াও গর্ভবতী মহিলাদের একাগ্রতা বাড়াতে সাহায্য করে।
সকাল বেলার দুর্বলতা কমায়
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পেয়ারা সকালের দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে।
তবে পেয়ারা খাওয়ার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে:
১. পেয়ারা ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে ডায়রিয়ার ভয় থাকে।
২. ধুয়ে বা খোসা ছাড়িয়ে না-খেলে লিস্টেরিওসিসের মতো সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়।
৩. পেয়ারার কোনও ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট খাবেন না। ফল হিসেবেই পেয়ারা খাওয়া শ্রেয়।
উল্লেখ্য, লাল পেয়ারার চেয়ে সাদা পেয়ারা স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী। পেয়ারা সকালের নাস্তায় বা জলখাবার হিসেবে খাওয়া যেতে পারে
পেয়ারা প্রায় প্রতিটি দেশেই একটি অতি সাধারণ এবং সহজলভ্য ফল। এর স্বতন্ত্র স্বাদ এবং গন্ধ ছাড়াও এর অনেকগুলি স্বাস্থ্য-বর্ধক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শুধু ফল নয়, গাছের পাতারও রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা। তাই সম্ভব হলে প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিন একবার পেয়ারা খাওয়া উচিত।
1 Comment