অফিস বা কর্মক্ষেত্রে সুস্থ থাকার গুরুত্বপূর্ণ টিপস
কর্মক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য। প্রতিটি কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য মানব সম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সংস্থার সাফল্য মূলত এই মানব সম্পদ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের উপর নির্ভর করে। অন্যান্য সকল সম্পদেরই অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে যেখানে মানবসম্পদ বা কর্মীরা বাদে এগুলো পুরোপুরিই অচল হয়ে পড়ে। কর্মীদের বলতে বুঝিয়েছি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত সকলকে। এই কারণেই সমস্ত সংস্থা তাদের কর্মীদের মঙ্গলকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়। তাই আপনাকেও এই প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান অনেক কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। এই সমস্ত কিছু মাথায় রেখে, বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার কারণে যারা কর্মক্ষেত্রে ভালো পারফর্ম করতে পারছেন না, তাদের জন্য এই লেখাটি খুবই উপযোগী হবে বলে আশা করছি।
সুস্থতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যেহেতু প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য সেখানে নিযুক্ত কর্মীদের উপর নির্ভর করে, তাদের শারীরিক সুস্থতা এখানে একটি মূল বিষয়। কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাদের কর্মক্ষমতা কমে যায় যা কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো নয়। অফিসে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, চোখ ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি সমস্যায় ভুগি। যা আমাদের উত্পাদনশীলতা হ্রাস করে।
দিন শেষে দেখা যায় কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ও আয় কমছে। কিন্তু কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এই ধরনের অসুখ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। যেমন ঘাড় ব্যথা বা কোমর ব্যথার অন্যতম কারণ হলো ভুলভাবে বসে থাকা এবং দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা। এখানে সঠিক নিয়ম মেনে চললে এ ধরনের রোগ এড়ানো যায়।
আর দীর্ঘ সময় বসে থাকাটা আপনার ক্যারিয়ারের জন্য প্রথমে ভালো মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর অনেক অসুবিধা রয়েছে। এতে আপনার কাজের মান এবং উৎপাদনশীলতা দুটোই কমে যাবে। অতএব, এই দিকগুলি বিবেচনা করে, আমাদের সকলের উচিত কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা।
সুস্থ থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়
এই চরম প্রতিযোগিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাইলে শারীরিক সুস্থতা একটি অপরিহার্য বিষয়। অফিসে সবসময় কাজের চাপ থাকবে। এগুলো নিয়েই আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় সতর্কতার সাথে মেনে চললে সবসময় শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে বাধ্য। এরকম কিছু কার্যকরী উপায় নিচে দেওয়া হল। এইগুলি অনুসরণ করে, আশা করি কর্মক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখব।
আমরা যারা সারাদিন কাজ করি তারা সবসময় কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আমরা নিজেদের সঠিক যত্ন নিতে পারি না। সেই ক্ষেত্রে, আমাদের নিজেদের যত্ন নেওয়ার সময় নেই, তাই আমরা পরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আসুন জেনে নিই ক’টি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য টিপস, যাতে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সক্রিয় থাকেন।
বিনোদনমূলক কাজে অংশ নিইঃ
বড় কোম্পানিতে অফিসে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজের সুযোগ রয়েছে। যেমন, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল ইত্যাদি। এই কার্যক্রমগুলো আমাদের শারীরিকভাবে ফিট রাখতে সাহায্য করে। আপনার অফিসে যদি এমন সুবিধা থাকে তবে আপনি অবশ্যই এটি ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, যদি উপলব্ধ না হয়, অফিসের বাইরে কিছু সুবিধাজনক দিনে আপনার পছন্দের খেলায় অংশ নিন। এটি আপনার মন এবং শরীর উভয়ই ভালো রাখবে ।
কাজের ফাঁকে একটু এক্টু ঘোরাঘুরি করাঃ
অফিসে একটানা বসে না থেকে একটু একটু করে ঘোরাঘুরি করুন। দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে থাকলে মেরুদণ্ডের ক্ষতি হতে পারে। চেয়ারে হেলান দিয়ে না বসে সবসময় সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করুন। যদি পারেন, একটু বিরতি নিন এবং একটু ঘুরে আসুন। চেয়ারে বসে কিছু ব্যায়ামও করতে পারেন।
চোখের যত্ন নিনঃ
সারাদিন অফিসে কম্পিউটারের সামনে অনেক সময় কাটে। ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি হতে পারে। তাই প্রতি এক ঘণ্টা কাজ করার পর চোখ বন্ধ করে এক-দুই মিনিট বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও আপনি উঠে আপনার মুখে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দিতে পারেন। তবে কম্পিউটারের সামনে কাজ করতে চোখের বেশি সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমানঃ
প্রত্যেক মানুষের নিয়মিত ৬-৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এর চেয়ে কম ঘুমালে নানা সমস্যা হতে পারে। মূলত, ঘুমের অভাব আপনার অফিসের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং আপনার কর্মক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রাতে চা, কফি, কোমল পানীয় ইত্যাদি পান করলে ঘুমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। আর অফিসে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট ক্লান্তি দূর করতে পান করতে পারেন আদা চা, লেবু চা বা গ্রিন টি।
বাইরের খাবার খাবেন নাঃ
আমরা প্রায়ই সকালের নাস্তা না করে অফিসে চলে যাই। ফলে সকালের নাস্তা ও দুপুরে বাইরের খাবার খাই, এতে নানা সমস্যা হতে পারে। এটি অ্যাসিডিটি থেকে খাদ্য বিষক্রিয়া পর্যন্ত হতে পারে। তাই সুস্থ থাকতে যতটা সম্ভব বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন।
খাবারে সচেতন হোনঃ
জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন। শুধু অফিসে আছেন বলে আপনার সামনে যা আসে তা খাওয়া ঠিক নয়। কম ক্যালোরি খান। মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। মাঝে মাঝে খেয়ে ফেললেও খুব কম খান।
সুষম খাদ্য গ্রহণঃ
নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে আপনি সুস্থ থাকবেন। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার খাবেন না। সেক্ষেত্রে ঘরে তৈরি কম ক্যালরির খাবার খান। আপনি সালাদ খেতে পারেন, কারণ এতে ক্যালোরি কম এবং ফাইবার বেশি। এছাড়াও আপনি আপনার খাদ্যতালিকায় তাজা ফল অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
পর্যাপ্ত পানি পান করুনঃ
কাজের চাপে অনেকেই ঠিকমতো পানি খেতে ভুলে যান। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি পান না করলে ডিহাইড্রেশন থেকে শুরু করে মূত্রনালীর সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। তাই বেশি করে ফুটানো পানি, জুস, ডাবের পানি ইত্যাদি পান করার চেষ্টা করুন। এছাড়াও আপনার টেবিলে সব সময় পানির পাত্র রাখুন এবং বিরতিতে পানি পান করুন।
ব্যায়াম নিয়মিত করুনঃ
অফিসের চেয়ারে বসে থাকার কারণে পেট ও কোমরে বেশির ভাগ মেদ জমে থাকে। আর তা শরীরের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। তাই অফিসের ফাঁকে একটু হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করুন । অফিসের বাইরেও আপনি একটি ভাল জিমে যোগ দিতে পারেন। আপনি সাইক্লিং, স্পিনিং, যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশনও করতে পারেন। ব্যায়াম আপনার শরীর ও মনকে সুস্থ রাখবে।
মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে বাইরে হাঁটুনঃ
সারাক্ষণ একই জায়গায় বসে থাকা বিরক্তিকর হতে পারে। আপনার যদি এটির জন্য সময় থাকে তবে বাইরে দেখুন। বেশিরভাগ অফিসে ১ ঘন্টা লাঞ্চ ব্রেক আছে। এই বিরতির সময় অফিসের বাইরে হাঁটুন। এক্ষেত্রে অফিস থেকে কোনো বন্ধুকে নিয়ে যেতে পারেন। এতে করে আপনি কথা বলে ভালো সময় কাটাতে পারবেন। মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় এই হালকা হাঁটা অভ্যন্তরীণ চাপ কমিয়ে দেবে এবং পরবর্তীতে আপনি সঠিকভাবে কাজে মনোযোগ দিতে পারবেন।
খুব উপরে না হলে সিঁড়ি ব্যবহার করুনঃ
আপনি লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কারণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। আপনার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব কম হলে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যান। এসব করলে আপনি সুস্থ থাকবেন।
ইতিবাচক মনোভাব রাখুনঃ
সব ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করুন। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে অপবাদ, গসিপ বা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন না। কারণ আপনার ব্যক্তিগত জিনিস শেয়ার করলে পরে বিব্রত হতে পারেন। সুতরাং, পেশাদারিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করুন এবং সততার সাথে আপনার কাজ করুন।
ধূমপান এড়িয়ে চলুনঃ
ধূমপানের ক্ষতি সীমাহীন। এটি আপনাকে তাত্ক্ষণিক মানসিক স্বস্তি দিতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে ধূমপান আপনার শরীরের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগ, ক্যান্সার, দাঁতের সমস্যা, চোখের সমস্যা, কানের সমস্যা, প্রজনন সমস্যা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি ধূমপানের কারণে সৃষ্ট অতি সাধারণ কিছু রোগ। আপনি যদি নিয়মিত ধূমপান করেন তবে এই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে সর্বনাশ করে ফেলবে। তাই এগুলো এড়াতে ধূমপানের অভ্যাস থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্যাগ করুন।
ছুটির দিনে নিজেকে কর্ম মুক্ত রাখুনঃ
সারা সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রম করার পর ছুটির দিনে যতটা সম্ভব নিজেকে কর্ম মুক্ত রাখুন। পরিবারকে সময় দিন। তাদের সাথে বাইরে যান। আপনার মাথা থেকে অফিস পুরোপুরি ছেড়ে দিন এবং পুরো সময় উপভোগ করুন। এছাড়াও সপ্তাহের চাপ কাটিয়ে উঠতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। এভাবে সময়গুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে আপনি নতুন সপ্তাহ শুরু করতে পারেন। এতে করে একদিকে যেমন আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় থাকবে, অন্যদিকে আপনার উৎপাদনশীলতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন
অধীনস্থদের (কর্মচারী-কর্মকর্তাদের) প্রতি মালিকদের আচরণ: ইসলামী নমুনা
খাদ্যে বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং কেন হয়? তখন কী খাবেন আর কী খাবেন না
যান্ত্রিকীকরণের এই যুগে আমরা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যন্ত্রের মতো কাজে ডুবে আছি। আর যার ফলশ্রুতিতে একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন কখনও কখনও আমাদেরকে বিতৃষ্ণার দিকে নিয়ে যায়। এতে আমাদের শরীরে নানান রোগ হয় এবং আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই ব্যস্ততার জন্য নিজের ক্ষতি না করে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য কিছু নিয়মকানুন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করুন।
এই ছিল কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে ফিট থাকার সেরা ক’টি উপায়। যারা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, তারা নির্দ্বিধায় এই নিয়মগুলো মেনে চলতে পারেন। আশা করি এটি আপনার আমার সবার ক্যারিয়ারে ভাল ফলাফল নিয়ে আসবে।
1 Comment