নারী শিক্ষার পথিকৃৎ মহানবী (সা.)
অবহেলিত নারী সমাজকে শিক্ষিত করে তামাম দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে ব্যক্তি, সেই ব্যক্তির নামই মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নারী শিক্ষার প্রসারে এবং নারী শিক্ষায় উৎসাহ প্রদানে এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর চেয়ে এতটা অগ্রসর তাবৎ দুনিয়াতে কেউ ছিলনা। নারী শিক্ষার পাইওনিয়ার বা পথিকৃৎ মানবতার নবী মুহাম্মদ (স.) ।
মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রায় ১৫০০ বছর আগে সর্বপ্রথম নারীর পূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারী শিক্ষার প্রসারে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিহাসের এক কালজয়ী অধ্যায়ের সূচনা করেন।
মহানবী (সা.) নারীদের যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়েছেন তা চিরকাল উজ্জ্বল থাকবে। কোন ব্যক্তি, আইন, জীবন পদ্ধতি, অতীত বা বর্তমান, তিনি নারীকে যে অধিকার দিয়েছে তা দিতে পারেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখলেন জাহিলি সমাজ নারীদের প্রতি চরম অবজ্ঞা, নিপীড়ন ও অন্যায় আচরণ করছে। এমনকি জাহিলী সমাজ নারীকে অশুভ মনে করত এবং তাদের কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত। ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘আমরা অজ্ঞতায় নিমজ্জিত ছিলাম। নারীদের কোনো গুরুত্ব দেইনি। যখন ইসলামের আবির্ভাব হয় এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদা উল্লেখ করেন, তখন আমরা দেখেছি যে আমাদের উপর তাদের অধিকার রয়েছে, এতে আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’ (বুখারি)।
জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে নারী ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নবী (সা.)
এ ক্ষেত্রে তিনি নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছেন এবং নারী শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ’ (ইবনে মাজাহ)। এই হাদিসে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।
রাসুল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার দু’টি আয়াত দিয়ে শেষ করেছেন- যা আমাকে আরশের নিচের ধনভান্ডার থেকে দান করা হয়েছে।” কাজেই এগুলো তোমরা নিজেরাও শিখো এবং তোমাদের নারীদেরকে শিক্ষা দাও’ (দারেমি )। আনসারী মহিলারা দ্বীনের গভীর জ্ঞানে খুব আগ্রহী ছিল, তাই আয়েশা (রা) তাদের প্রশংসা করে বললেন, আনসারী মহিলারা কত ভালো! লজ্জা তাদের ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয় না’ (মুসলিম : ৩৩২)। মূলত, ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের জন্য কখনো আলাদা নির্দেশনা দেয়নি, বরং সবার জন্যই নির্দেশ দিয়েছে।
মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে নারীদের শিক্ষিত করার জন্য নারীর পিতামাতাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা তিন কন্যা বা তিন বোনকে লালন-পালন করেছে, তাদের আদব শিক্ষা দিয়েছে এবং তাদের প্রতি করুণা করেছে, অবশেষে আল্লাহ তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছেন। যদি তাই হয়, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের ব্যবস্থা করবেন। অতঃপর জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) যদি তিনি দুই মেয়েকেও বড় করেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘দুটি করলেও’ ‘ (মিশকাত)।
একবার এক মহিলা রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), আপনার হাদিস শুধুমাত্র পুরুষরাই শুনতে পারে। সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করুন, যেদিন আমরা আপনার কাছে আসব, আপনি আমাদেরকে তা থেকে শিক্ষা দেবেন যা আল্লাহ আপনাকে শিখিয়েছেন।’ তিনি বললেন, তোমরা অমুক দিনে অমুক স্থানে সমবেত হবে। সে অনুযায়ী তারা সমবেত হয়। রাসুল (সাঃ) তাদের কাছে আসলেন এবং আল্লাহ তাকে যা শিখিয়েছিলেন তা থেকে তাদেরকে শিক্ষা দিলেন।’ (বুখারি)
এভাবে মহানবী (সা.) মুসলিম নারীদের অন্তরে জ্ঞানের প্রবল আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেন। ফলে ইসলামের প্রথম যুগের নারীরা হাদিস বর্ণনায় ব্যাপক সাড়া দিয়েছিল। ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) তার গ্রন্থ আল-ইসাবাহ-এ ১৫৪৩ জন মহিলা হাদীস বর্ণনাকারীর উল্লেখ করেছেন এবং তাদের পাণ্ডিত্য ও বিশ্বস্ততার সাক্ষ্য দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন নারী শিক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিপুল সংখ্যক ছাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং দ্বীনের জ্ঞান শিখেছেন। মুসলিম নারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষক, সর্বোচ্চ মানের মুফতি( ইসলামী আইন বিশারদ), সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। তিনি ছিলেন আরবের ইতিহাস, চিকিৎসা ও আয়াত সাহিত্যে অধিক জ্ঞানী, অধিকতর সঠিক সিদ্ধান্ত ও বলিষ্ঠ যুক্তি উপস্থাপক, পার্থিব জ্ঞানে অধিকতর পারদর্শী এবং ধর্ম সম্পর্কে অধিক বোধগম্যের অধিকারী । তিনি তাফসীর, হাদিস, ফারায়েজ, আরবি সাহিত্য এবং নসবানামা সম্পর্কে তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান এবং বাগ্মীতার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন।
রাসুল (সাঃ) এর যুগে এবং পরবর্তী যুগে, মুসলিম মহিলারাও চিকিৎসা, কবিতা, সাহিত্য এবং আইনের মতো জ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর যুগে অনেক নারী চিকিৎসা সেবায় জড়িত ছিলেন। যুদ্ধে আহতদের সেবা করার জন্য তারাও মহানবী (সা.)-এর সাথে যুদ্ধে গিয়েছিলেন । নুসায়বাহ বিনতে কাব আল-আনসারী (রাঃ) ছিলেন মদীনার একজন প্রখ্যাত মহিলা চিকিৎসক। এই মহিলা সাহাবী উম্মে আম্মারা নামে বেশি পরিচিত। তিনি নবী (সাঃ) মদীনায় হিজরতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। উহুদ যুদ্ধের সময় নবী (সাঃ)-কে রক্ষা করার জন্য তাঁর লড়াই, চেষ্টা ইতিহাসে সর্বাধিক পরিচিত।
আরও পড়তে পারেন
হাদিসের আলোঃ মানবজীবনের অমূল্য ৫টি সম্পদ
এমনকি মধ্যযুগেও, মুসলিম নারীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে পারদর্শী ছিলেন। ইবনে কাসির সহ ইতিহাসবিদরা দশম শতাব্দীর একজন মহিলা গণিতবিদকে প্রশংসা করেছেন। সুতাইতা মহামালি নামক, একজন মহিলা গণিতবিদ, বাগদাদের একটি উদ্যমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা বাগদাদে একজন বিচারক ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
এ ছাড়া তিনি আরবি সাহিত্য, হাদীস ও আইনশাস্ত্রেও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। লুবনা কুরতুবিয়া মধ্যযুগে আন্দালুসিয়ার উমাইয়া দরবারের একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি গণিত, কাব্য, ব্যাকরণ ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তার কারণে তিনি খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমান এবং তার পুত্র হাকাম দ্বিতীয়ের দরবারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মহানবী (সা.)-এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে এভাবেই অনেক মুসলিম নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতার চিহ্ন রেখে গেছেন। আর এই সকল অবদান এর মূল কর্মকার মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
1 Comment