শয়তানের প্রভাব ও প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায়
মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ যেমন শয়তানকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, তেমনি তিনি মুমিনদেরকে শয়তানের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তিনি শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় ও পদ্ধতি প্রকাশ করেছেন। কোরআনের একটি আয়াত দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। কারণ শয়তান যখন আল্লাহর সামনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শর্ত আরোপ করে তখন সে বিশ্বস্ত বান্দাদেরকে আলাদা করে ফেলেছে। শয়তানের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘সে বলেছে, তোমার গৌরবের কসম, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। তাদের মধ্যে আপনার বিশ্বস্ত বান্দা ছাড়া।’ – (সূরা জুমার: ৮২-৮৩)
শয়তান কখনো একজন প্রকৃত মুমিনকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। কেননা মুমিনের কর্ম ও সুরক্ষা শয়তানের ফাঁদ থেকেও শক্তিশালী। শয়তানের প্ররোচনা, প্রতারণা এবং প্রভাব এড়াতে নিচে কিছু উপায় দেওয়া হল।
চোখের হেফাজত করাঃ
কারণ চোখের মাধ্যমেই সকল পাপের সূচনা হয় । এবং শয়তান এভাবে নারী এবং পুরুষের মাঝে প্রবেশ করে। বেগানা নারী ও পুরুষের মাঝে সম্পর্ক গড়ে তোলে । এবং শয়তান অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে চূড়ান্ত কাজে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তাদের সাথে লেগে থাকে । তাই আল্লাহ আল্লাহর রাসূলের কথা মেনে অবশ্যই আমরা পর নারী অথবা পর পুরুষের থেকে চক্ষুকে সংবরণ করে চলবো । তাহলে শয়তানকে জায়গায় থামিয়ে দেওয়া যাবে । সামনে সে সুযোগ মোটেও পাবে না।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতঃ
কুরআন আল্লাহর বাণী। কুরআন তিলাওয়াত শয়তান থেকে রক্ষার একটি দুর্গ। একাধিক হাদিসে বলা হয়েছে যে, কুরআন তেলাওয়াত শুনে শয়তান পালিয়ে যায়। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ঘুমানোর সময় আয়াতুল কুরসি পাঠ করে, আল্লাহ তার জন্য একজন অভিভাবক ফেরেশতা নিযুক্ত করেন এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তার কাছে আসতে পারে না।
সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াতও শয়তান থেকে সুরক্ষা দেয়। হজরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে একটি কিতাব লিখেছিলেন। যে কিতাব থেকে সূরা বাকারা দুটি আয়াত নাজিল করে শেষ করা হয়েছিল। যে ঘরে দিন রাত এই দুই আয়াত পাঠ করা হয়, শয়তান সেই ঘরের কাছে আসে না।
কোরআনের শেষ দুটি সূরা (সূরা ফালাক ও সূরা নাস ) শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে, তাকে প্রতিহত করতে, শয়তানের হাত থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার ক্ষেত্রে চমৎকার প্রভাব ফেলে। সূরা দুইটি জিন ও মানুষের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে শেখায়। এ দুটি সূরার মাধ্যমে হজরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিন ও মানুষের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। একবার তিনি যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়লে এই দুটি সূরা দ্বারা তিনি আরোগ্য লাভ করেন। সকাল-সন্ধ্যা, শোবার সময়, প্রত্যেক নামাযের পরে এবং অসুস্থতার সময় এ দুটি সূরা পাঠ করা বিভিন্ন সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদা করলেঃ
অন্য হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদা করে, তখন শয়তান কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায় এবং বলে, হায়! আদম সন্তানকে সেজদা ও সিজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যার বিনিময়ে তার জন্য জান্নাত নির্ধারণ করা হয়েছে । এবং যখন আমাকে সিজদা করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন আমি অস্বীকার করেছিলাম এবং জাহান্নাম আমার জন্য নির্ধারিত হয়েছে । – (সহীহ মুসলিম)
ইখলাস বা আন্তরিকতা অবলম্বনঃ
শয়তানের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার প্রধান এবং সবচেয়ে শক্তিশালী কাজ হল আন্তরিকতা। প্রতিটি সৎকাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করাই হল আন্তরিকতার সারমর্ম। যে ব্যক্তি ইখলাসকে জীবনে সঙ্গী করেছে, শয়তান তাকে কিছুতেই বিভ্রান্ত করতে পারে না।
আন্তরিকতার সাথে করা কাজ আল্লাহ কবুল করেন, আন্তরিকতা ছাড়া কাজ বৃথা। তাই আন্তরিকতা শয়তানের চরম শত্রু। কারণ ইখলাসের কাছে সে হারতে বাধ্য। তাই শয়তান ভালো কাজে মানুষের আন্তরিকতা নষ্ট করার চেষ্টা করে। করে। ইখলাস নষ্ট করতে সক্ষম হলে শয়তানের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়। নতুবা সে এখানে আটকে যায়। তাই শয়তানের চক্রান্ত থেকে বাঁচতে হলে আন্তরিকতাকে সঙ্গী করতে হবে।
চোখের হেফাজত করে চলাঃ চক্ষুকে বেগানা পুরুষ এবং নারীদের থেকে অবশ্যই সংরক্ষণ করে চলা। কারণ এটা শয়তানের বড় ধরনের অস্ত্রসমূহের মধ্যে একটি । চোখের মাধ্যমেই শয়তানের শয়তানি শুরু হয়। এবং চূড়ান্ত কাজ করিয়ে সে থামে। তাই চোখের হেফাজত করা । এবং তার মাধ্যমে শয়তানকে পরাস্ত করা।
রাগ নিয়ন্ত্রণঃ
রাগ শয়তানের অন্যতম অস্ত্র। রাগ মানুষকে দিয়ে অনেক বড় পাপ ঘটায়। খুন-খারাবি, মারামারি, গালাগালি ও ঝগড়াঝাটিসহ অনেক বড় বড় পাপের পেছনে রাগের ভূমিকা অন্যতম। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানুষ অনেক পাপ থেকে বেঁচে যায়। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার এক বিরাট মাধ্যম। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন ব্যক্তিকে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বড় বাহাদুর বলেছেন। -(সহিহ বোখারি)
জিকরঃ
কোরআন তেলাওয়াতের মতো বিভিন্ন জিকর-আজকারও শয়তানের হাত থেকে রক্ষার মাধ্যম। শয়তানের পক্ষে এমন ব্যক্তির কাছে যাওয়া কঠিন যে আল্লাহর জিকির বেশি বেশি করে। নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে যিকিরের মাধ্যমে শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তা হল
“”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়ীন কদির।””
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন এই দুআ পাঠ করবে, সে দশটি গোলাম আযাদ করার সমান নেকী পাবে, তার একশত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং এই দুআটি সে দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষার মাধ্যম হবে। – (সহীহ বোখারি)
আরও পড়তে
আশুরার তাৎপর্য ফজিলত এবং করণীয়
দেবর-ভাবী, শ্যালিকা-দুলাভাই দেখা-সাক্ষাত পর্দা । কি বলে ইসলাম?
বিসমিল্লাহ পড়াঃ
শয়তান থেকে বাঁচার আরেকটি উপায় হচ্ছে প্রতিটি কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা। আল্লাহর নামে কাজ শুরু করলে শয়তান থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হয় । যে ব্যক্তি শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় তার জন্য অপরিহার্য যে, সে প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ পাঠ করে। হাদিসে শয়তানকে পরাস্ত করার জন্য অনেক বিষয়ে বিসমিল্লাহ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহর কাছে দোয়াঃ
শয়তান থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে দোয়ার বিকল্প নেই। সব আমলের মূল হচ্ছে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। তাই সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা করেন।
তওবা-ইস্তেগফারঃ
মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদেরকে যখন শয়তান কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখ খোলে যায়।’ -সুরা আরাফ : ২০১
তাই শয়তান থেকে বাঁচতে আল্লাহতায়ালার জিকির ও তার আশ্রয় , তওবা-ইস্তেগফার এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা বেশি বেশি করে করতে হবে।
শয়তানের বিরুদ্ধাচারণ করাঃ
শয়তান যেসব কাজ ও মাধ্যম দ্বারা মানুষকে কাবু করে, সেগুলোতে তার সঙ্গ না দিয়ে বিরোধিত করলে সে পরাজিত হবে। তাই শয়তান ও তার কর্মের বিরোধিতা করা।
কাজে অনর্থক তাড়াহুড়া না করাঃ
কোনো কাজে তাড়াহুড়া করা শয়তানি কাজ। তাই এটা করা যাবে না।
বাম হাতে খাওয়া-দাওয়া না করাঃ
বাম হাতে খাওয়া-দাওয়া শয়তানি কাজ । কারণ বাম হাত আল্লাহতালা বিশেষ কিছু কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সেটা দ্বারা আল্লাহর পবিত্র নেয়ামত খাবার গ্রহণ করা মোটে উচিত হবে না। এবং সেটাকে পিতা-মাতা ছোট সময় থেকেই অভ্যাসে পরিণত করাতে হবে। এবং শিশুদেরকে শিখিয়ে নিতে হবে। তাই আমাদেরকে সর্বদা ডান হাতে খেতে হবে।
অহঙ্কার শয়তানি কাজ ও পতনের কারণঃ
অহংকার মানুষকে চিরতরে ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে তাই অহংকারকে চিরতরে মুছে দিয়ে শয়তানকে থামিয়ে দেওয়া অবশ্যই কর্তব্য। সুতরাং অহঙ্কার ছেড়ে বিনয় অবলম্বন করতে হবে
এক পায়ে জুতা পরে না হাঁটাঃ
এক পায়ে জুতা পরে হাঁটা শয়তানের কাজ তাই হয় উভয় পায়ে জুতা থাকবে, নতুবা উভয় পা খালি রাখবে।
অপচয় না করাঃ
কারণ এক পায়ে জুতা পড়ে হাটা শয়তান পছন্দ করে । আর শয়তানের নিয়ম হলো ছোট কোনো কাজের মাধ্যমে তাকে বড় খারাপ কাজের দিকে নিয়ে যাওয়া। তাই আমরা কখনোই এক পায়ে জুতা পড়ে হাটবোনা। হয়তো দুই পায়ে জুতা পরবো, না হয় দুই পা ই খালি রাখব।
অপচয়কারীকে কোরআনে কারিমে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। অপচয় করা একতো শয়তানি কাজ, আবার মানুষকে অভাবী করে তোলে অপচয়। তাই সচ্ছল থাকার জন্য কোনোভাবেই অপচয় করা যাবে না। এবং অপচয় না করে শয়তানের বিরুদ্ধে ধারণ করতে হবে।