ফ্রান্সের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের বাইরে
‘মানুষ মানুষের জন্য’ ফ্রান্স; কঠিন বিক্ষোভের মাধ্যমে একথার সঠিক প্রমাণ দিচ্ছে । একজন কিশোরকে পুলিশ অন্য এভাবে হত্যা করে বুঝে গেছে মানব হত্যা মানবকূল সহজ ভাবে নেয়না।
পুলিশের গুলিতে এক কিশোরের মৃত্যুর পর ফ্রান্সে শুরু হওয়া বিক্ষোভ তীব্রতর হচ্ছে। গত মঙ্গলবার নানটেরেতে একটি গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় নাহেল এল নামের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে।
এরপর শুরু হয় বিক্ষোভ। যা গত চার দিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। শনিবার (১ জুলাই) মধ্যরাতেও বিক্ষোভকারীরা তাণ্ডব চালায়। তারা গাড়িতে আগুন দেয়, দোকান ভাংচুর করে। কেউ কেউ লুটপাটেও অংশ নেয়। ওই রাতে এক হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। চারদিন ধরে বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করা হলেও তা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
শুক্রবার, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বিক্ষোভের বিষয়ে একটি জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা তাদের সন্তানদের বিক্ষোভে অংশ নিতে না দেন। তবে তার ডাকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এছাড়া সাধারণ মানুষের সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল, বিক্ষোভকারীরা তাও মানেনি।
গত রাতে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হয়েছে লিয়াওনিং শহরে। ফরাসি মিডিয়া জানিয়েছে যে শহরে কমপক্ষে ৩৫ জন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। যার মধ্যে দুইজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
আরও পুলিশ মোতায়েন না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করছেন নগরবাসী।
এদিকে বিক্ষোভের মধ্যে রুয়েনে এক যুবকের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে ফরাসি গণমাধ্যম। তারা বলেছে একটি সুপার মার্কেটের ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে তিনি প্রতিবাদকারীদের একজন ছিলেন কিনা — বা তিনি সুপারমার্কেট লুট করতে গিয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে সুপার মার্কেট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কোনো ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি।
অশান্তিতে ঘেরা ফ্রান্সঃ কেমন ছিলেন নাহেল?
পুলিশের গুলিতে এক কিশোর নিহত হওয়ার পর ফ্রান্সে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দেশটির সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা দাঙ্গা দমন করতে “সমস্ত বিকল্প” বিবেচনা করছে। যাকে ঘিরে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর চারদিন ধরে জ্বলছে, কে এই নাহেল ?
১৭ বছর বয়সী নাহেল প্যারিসের পশ্চিমে নান্টেসে বড় হয়েছেন। গত মঙ্গলবার সেখানে গাড়ি চালানোর সময় একটি চেকপয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে।
একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন মা। তিনি ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করতেন। রাগবি লিগেও খেলেছেন তিনি।
তবে নাহেলের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। তিনি ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিলেন। নাহেল এবং তার মা মনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত। তবে তার বাবার পরিচয় জানা যায়নি। যারা নাহেলকে চেনেন, তারা সবাই একই কথা বলেন- নাহেল খুব অমায়িক ছেলে ছিল।
ঘটনার দিন নাহেল তার মাকে চুমু খেয়ে বলে, ‘মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ মঙ্গলবার সকাল ৯টার কিছু পরে, খবর আসে যে নাহেল একটি প্রাইভেট কার চালিয়ে একটি পুলিশ চেকপয়েন্ট অতিক্রম করার সময় খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ছেলেকে হারানো মা মনিয়া বিলাপ করে বলেন, ‘এখন কী করব? আমি আমার সবকিছু তাকে উৎসর্গ করেছি। আমার একটি সন্তান ছিল, দশটি নয়। সে ছিল আমার জীবন, আমার সেরা বন্ধু।’ দাদি নাহেলকে ‘কোমল হৃদয়ের ভালো ছেলে’ বলে ডাকতেন।
আরও খবর
ক্যামেরার সামনে বিয়ার পান করায় সমালোচনার মুখে পড়েন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ
ফ্রান্সে মে দিবসের সমাবেশে সংঘর্ষ, পুলিশ সদস্য আহত ১০৮
সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অলিভিয়ার ফাউর বলেছেন, “আদেশ অনুযায়ী গাড়ি না থামানোর মানে এই নয় যে কাউকে হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।” রাজ্যের প্রতিটি শিশুর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেলসবাইকে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান নাহেলের মা মনিয়া।
নাহিলের মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর, অ্যাম্বুলেন্স চালক মারওয়ান একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তিরস্কার করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নাহেল তার ছোট ভাইয়ের মতো। সে তার বড় হওয়া দেখেছে। তার হৃদয় নরম ছিল। তিনি সবাইকে সাহায্য করেছেন। তিনি কখনো কারো গায়ে হাত তোলেননি এবং আক্রমণাত্মক ছিলেন না।
নাহেলের মা মনিয়া ফ্রান্স টিভিকে বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন যে, পুলিশ অফিসার নাহেলের জীবন নিতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি দেখতে আরব দেশের নাগরিকের মতো। তিনি শুধু এই ব্যক্তিকেই দোষারোপ করেছেন, পুরো পুলিশ বাহিনীকে নয়। তিনি বলেন, পুলিশে আমার অনেক বন্ধু আছে, তারা আন্তরিকভাবে আমার পাশে আছে।
নাহিলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংস বিক্ষোভ চতুর্থ দিনে প্রবেশ করেছে। একদিকে আন্দোলনকারীদের জ্বালাও পোড়াও হচ্ছে, অন্যদিকে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে। বিক্ষোভের তৃতীয় রাতে পুলিশ ফ্রান্স জুড়ে অন্তত ১০০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।