গুমের ঘটনায় হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ট্রাইব্যুনালের
গুম:
গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে গুমের শিকারদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা ও অমানবিক আচরণের কথা উঠে এসেছে। অমানবিক পিচ্চাস পতিত হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১৭০০ টি গুমের রিপোর্ট করা হয়েছে, অনেকের মৃত্যু হয়েছে, এবং যারা ফিরে এসেছে তারা দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে-
১. প্রথমে কাউকে আটক করা,
২. তারপর অন্যের নাম বের করার জন্য নির্যাতন করা এবং তারপর তাদেরও গুম করা।
রাজনৈতিক গুম, যেখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির সরাসরি নির্দেশে গুম ও নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া নিখোঁজ নিহতের অবস্থান শনাক্ত করতে মোবাইল ফোনের নজরদারি ব্যবহার করা হয়েছে বলেও কমিশনের প্রতিবেদনে জানা গেছে
.আদালত তাদের গ্রেপ্তার করে ১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)।
তাদের গ্রেপ্তার করে ১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।
প্রসিকিউশন তাদের গ্রেফতারের আবেদন করেছে।
এই ১১ জনের মধ্যে তিনজন হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ।
আজ শুনানিতে প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, “আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের সংস্কৃতি চালু করেছে। যারা গুম করেছে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, র্যাব, ডিবি, সিটিটিসি এবং ডিজিএফআই গুমের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত।
পরে ট্রাইব্যুনালের আদেশ শেষে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, “গত ১৫ বছরে গুম ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষকে সাদা পোশাকে কিংবা পোশাকধারী বিভিন্ন বাহিনী এসে তুলে নিয়ে যেত। এরপর তারা আর কোনোদিন ফিরে আসতেন না, অধিকাংশই ফিরে আসেননি।”
তিনি বলেন, “কেউ কেউ ফিরে আসলেও তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। আর কেউ কেউ স্বৈরশাসনের অবসানের পর ‘আয়নাঘর’ থেকে ফিরে এসেছেন।”
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “গুমের সংস্কৃতির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে মানুষকে নির্যাতন, হত্যাসহ তাদের সব ধরনের স্বাধীনতা বঞ্চিত করার যে অপরাধ, এটি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি অপরাধ। সেইসঙ্গে এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনেও মানবতাবিরোধী অপরাধ” ।
“তাই আজকে পৃথক একটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন জানিয়েছিলাম। এরমধ্যে তার (শেখ হাসিনা) নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার ১১ জন রয়েছেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন,” যোগ করেন তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরও বলেন, “আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট আসলে ওইদিন আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আর যদি এরমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট না জমা দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আসামিদের গ্রেপ্তারের অগ্রগতি প্রতিবেদন জামা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, যেহেতু গুম অপরাধের ধরন জুলাই-আগস্টের গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের থেকে ভিন্ন, তাই এসব অভিযোগ পৃথক করে শীর্ষ ১২ আসামির বিরুদ্ধে আজ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। প্রাথমিক শুনানি শেষে ১১ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়। প্রসিকিউশন বলেছে, গুমের অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শত শত মানুষকে বছরের পর বছর আয়নার ঘরে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এবং পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানো, পদোন্নতি দেওয়াসহ গুম করার নানা প্রলোভন দেখানো হয়। এবার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করে বাহিনীকে দায় মুক্ত করা হবে।