February 5, 2025
কাজী নজরুল ইসলাম, জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিরোধানের ৪৮ বছর পর

কাজী নজরুল ইসলাম, জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিরোধানের ৪৮ বছর পর

কাজী নজরুল ইসলাম, জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিরোধানের ৪৮ বছর পর

কাজী নজরুল ইসলাম, জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন তিরোধানের ৪৮ বছর পর

“বল বীর, বল বীরবল উন্নত মম শির।শির নেহারি আমারি নত শিরওই শিখর হীমাদ্রির।”

বিপ্লবী সরকার বিদ্রোহী কবিকে জাতীয় মর্যাদায় জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এটাই সার্থকতা এবং বাস্তবতা। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে তার ৫০ টি বছর কেটে গেলেও তিনি জাতীয় কবির স্বীকৃতি পাননি। এই মহান কবিকে মৃত্যুর ৪৮ বছর পরে হলেও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে।

জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম দীর্ঘদিন ধরে মানুষের ঠোঁটে থাকলেও রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি ছিল না। এবার সেই স্বীকৃতি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উত্থাপিত প্রস্তাবটি বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছিল না। এবার সেই শূন্যতা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্তকে নজরুলের অবদানের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর ঐতিহাসিক উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সাল থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। শুধু কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট আইনে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবার সেই স্ট্যাটাসের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী নজরুল শৈশবে ‘দুখু মিয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন তার নিকটাত্মীয়দের। আর্থিক অনটন তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। সকল বাধা অতিক্রম করে অবশেষে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তাঁর লেখা। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সাথে সাক্ষাতের তিন বছর পর তিনি বিয়ে করেন। কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ কবি পরিবারে আসেন। ১৯৪২ সালে, অজ্ঞাত কারণে নজরুল ধীরে ধীরে বাকশক্তি হারান। স্বাধীনতার পরপরই অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি হন তবে স্বীকৃতি পাননি। ১৯৭৬সালে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। সে বছর ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র) ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে নজরুলকে সম্মানসূচক ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করে। নজরুলকে ১৯৭৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, পদ্মভূষণ উপাধি পেয়েছেন।

তিনি ৩৪ বছর ধরে সাহিত্য সাধনা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন।  ১৯৭৬ বছরের ২৯ আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) মানবতা ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে জাতীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বাংলা ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী তার জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে।

মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান অতুলনীয়।

তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো-রণ সংগীত: চল্ চল্ চল্। ছোট গল্প: ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলি মালা। উপন্যাস: বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা। কবিতা: প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, বিদ্রোহী, কামাল পাশা, খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু, আনোয়ার, রণভেরী, কোরবানী ও মোহররম।

শৈশবে পিতৃহীন নজরুল প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পাস করার পর সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন। গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকরিও নেন।

রাড়া বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের লোকনাট্য, কবিতা, গান এবং নৃত্যের একটি মিশ্র রূপ লেটো দলে যোগ দেওয়ার কয়েকদিন পর নজরুলের শিক্ষকতার জীবন শেষ হয়। সেই সময়েই তিনি কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৯১০ সালে, লেটো গানের দল ত্যাগ করার পর, নজরুল প্রথমে রানিগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুলে এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশন) ভর্তি হন, কিন্তু আর্থিক অসুবিধার কারণে তাকে আবার আসানসোলে একটি চা ও রুটির দোকানে কাজ নিতে হয়। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজ উল্লাহর সঙ্গে দেখা হয় তার।

রফিজ উল্লাহর পীড়াপীড়িতে নজরুলকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে এক বছর অবস্থান করেন। সেই ত্রিশালে নজরুলের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

নজরুল ১৯১৭ সালের শেষের দিকে স্কুল ত্যাগ করেন এবং প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ না করেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর সামরিক কর্মজীবন ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর স্থায়ী হয়েছিল।

নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। তার জ্বলন্ত কবিতার বজ্রধ্বনিতে ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে ওঠে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন।

একের পর এক প্রকাশিত হয় তাঁর অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

সঙ্গীতে নজরুলের প্রতিভার আরেকটি দিক জ্বলজ্বল করে। শ্যামা সঙ্গীত এবং ইসলামী গজল- উভয় ধারাতেই সমান দক্ষতার পরিচয় দেওয়া নজরুল চার হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন।

তার সামরিক কর্মজীবনের সমাপ্তির পর, নজরুল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমেদের সাথে দেখা করেন। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অগ্রগামী লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর গান ও কবিতা ছিল অনুপ্রেরণার উৎস।

ওই বছরের ২৯শে আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন মানবতা ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে জাতীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে সবাই কাজী নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ বললেও এখন পর্যন্ত তাকে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইনে জাতীয় কবি হিসেবে শুধু কাজী নজরুল ইসলামের নাম উল্লেখ আছে।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে নজরুলের প্রতি জাতির আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশিত হলো।

আরো জানতে
অধীনস্থদের (কর্মচারী-কর্মকর্তাদের) প্রতি মালিকদের আচরণ: ইসলামী নমুনা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

X