গুমের অভিযোগে আয়নাঘরের কারিগর ২৪ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ
আয়নাঘর
আয়নাঘর,বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পলাতক স্বৈরাচার নির্মম শেখ হাসিনার গড়া গোপন আটক কেন্দ্রের নাম। এটি বাংলাদেশী প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স (DGFI) দ্বারা পরিচালিত হতো।
আমেরিকার কারাগার গুয়ানতানামো বে-তে কারা কারা আছে তা অন্তত জানা যেত, জার্মান নাৎসি বাহিনীর হাতে কারা কারা অত্যাচারিত হয়েছে তাও জানা থাকতো। কিন্তু নরখাদক শেখ হাসিনার কারাগার আয়নাঘরে কারা নির্যাতনের শিকার তা জানারও উপায় ছিল না। ৩৬ জুলাই এর বিপ্লবের পর সেই নির্মম অত্যাচারী শেখ হাসিনার আয়নাঘরের বাস্তবতা ফুটে ওঠে এবং একে একে বের হতে থাকে লোমহর্ষক সকল কাহিনী। আর সামনে এগোতে থাকে ন্যায় বিচারের নতুন বাংলাদেশ।
হাসিনা সরকারের আমলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাসহ ২৪ জনের পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এতে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে শক্তিশালী ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (এনএসআই) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই আলোচিত ‘আয়না ঘরের’ কারিগর বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো এক চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে পাসপোর্ট বিভাগ অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। তবে এরই মধ্যে অধিকাংশ কর্মকর্তা বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা সেবা বিভাগের উপসচিব কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে মোট ২২ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, নিখোঁজের তদন্ত কমিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিখোঁজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে। তদন্তে উল্লিখিত ব্যক্তিদের যাতে দেশ ত্যাগ করা না হয় সেজন্য তাদের পাসপোর্ট বাতিলসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকার অধিকাংশ কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী বলে জানা গেছে। কেউ কেউ ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধান ছিলেন। বাকিরা চাকরি জীবনে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আসামিদের মধ্যে সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম মতিউর রহমানও রয়েছেন। এস এম মতিউর রহমান কর্নেল থাকাকালীন ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও, তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থাকাকালীন ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স (DGFI) এর কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (CTIB) এর ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২৩ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সম্প্রতি ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি) পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা সেবা বিভাগের উপ-সচিব মো. তদন্তে উল্লিখিত ব্যক্তিরা যাতে তদন্তের স্বার্থে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য তাদের পাসপোর্ট বাতিলসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবরের নাম । তিনি হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ থেকে ২২ জুন, ২০১১ পর্যন্ত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের (টিএফআই) দায়িত্বে ছিলেন। তালিকায় আরও রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আকবর হোসেন, সাইফুল আবেদীন, সাইফুল আলম, আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল হামিদুল হক। যারা বিভিন্ন সময়ে ডিজিএফআই ও এনএসআই-এর শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আলোচিত আয়না ঘর তৈরি, গুম ও রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারে দমনসহ গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
তালিকায় আরও রয়েছে মেজর জেনারেল শেখ মামুন খালেদ, মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মোঃ সালেহ উদ্দিন, মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, মেজর জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তানভীর গণি চৌধুরী, কর্নেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাবেরী খান, র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, মেজর জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন। লেঃ কর্নেল কিসমত হায়াত, লেঃ কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হাসান, মেজর রাহাত উস সাত্তার, ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়াউর রহমান ও ওয়ারেন্ট অফিসার ইমরুল কায়েসের নাম। এ ছাড়া ইতিমধ্যে গ্রেফতার ও কারাগারে থাকা সাবেক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিনের পাসপোর্টও বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুজনেই চাকরি জীবনে দীর্ঘদিন ধরে র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে যুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে আলেপ উদ্দিন র্যাব-১১ এ কর্মরত থাকাকালে গুম ও ক্রসফায়ারের একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই কমিশনের চিঠিতে বলা হয়েছে যে উল্লিখিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৯ জন ডিজিএফআই-এর মধ্যে বিশেষ যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের (জেআইসি) দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে তারা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া সাবেক ডিজিএফআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল হামিদুল হককে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ডিজিএফআই-এর মধ্যে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে (সিটিআইবি) কর্মরত কর্মকর্তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন সময়ে র্যাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তাদের মধ্যে কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিচালক, র্যাব-১-এর কমান্ডার ও এডিজি ছিলেন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মোঃ সালেহ উদ্দিন সিটিআইবির কর্নেল জিএস ছিলেন। গুম কমিশন জানতে পেরেছে যে, তিনি বর্তমানে দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পালানোর চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া কর্নেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাবেরী খান, যার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে, তিনি ডিজিএফআই সদর দফতরের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। পাসপোর্ট বাতিলের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুম কমিশনের চিঠিতে বলা হয়েছে, এই কমিশনের কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার জন্য এই ব্যক্তিদের পাসপোর্ট বাতিল করা এবং তাদের দেশত্যাগে বাধা দিতে সব অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা একান্ত প্রয়োজন। । তাই আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে এবং নির্দেশনাসহ কমিশনকে জানাতে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, গত ৯ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টাসহ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে উপদেষ্টাদের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষিতে আংশিক তালিকা সংযুক্ত করে চিঠি পাঠানো হয়।
আরো জানুন