হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ দায়ের
বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট’২৪, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদ ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
লন্ডন ভিত্তিক থ্রি বোল্ট কোর্ট চেম্বার ব্যারিস্টার ড. আশরাফুল আরেফিন গত ২৮ অক্টোবর এ অভিযোগ করেন।
শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের স্বাধীন তদন্ত এবং মূল সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন আইনজীবী।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) দুপুরে লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মামলার বাদী এ তথ্য জানান। তিনি আইসিসির রোম সংবিধির ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী এবং অন্যান্য প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই এবং আগস্ট ২০২৪ সালে, বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নৃশংসতার সাক্ষী ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আশরাফুল আরেফিন আরও বলেন, চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে কোটা পুনর্বহাল এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ পদ সংরক্ষণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে।
তারা দাবি করেছে যে এই কোটা পদ্ধতি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে অযাচিত অগ্রাধিকার দেয়, যা দেশের মেধাবী এবং যোগ্য প্রার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগকে বাধা দেয়। আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কোটা সংস্কার, কিন্তু পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর মতো ঘটনার পর তা দ্রুত একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ছাত্ররা তখন শুধু কোটা সংস্কার নয়, প্রশাসনিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনে নামে।
এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে, সরকার অমানবিক সহিংসতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানায়, কারণ সরকার ছাত্রদের দমন করতে পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের মতো বাহিনী মোতায়েন করেছিল। ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে এই বাহিনী নির্বিচারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর জীবন্ত গোলাবারুদ, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র – যেমন বার্ডশট প্লেট এবং জীবন্ত গোলাবারুদ ব্যবহার করে আক্রমণ করে। ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতায় ১৪,০০ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে। বাংলাদেশ সরকারের এসব কঠোর পদক্ষেপের ফলে দেশে গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও অসংখ্য প্রতিবাদকারী গুমের ঘটনা ঘটেছে। এই নিষ্ঠুরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজগুলি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের উদাহরণ।
বলা হয়, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এই গুরুতর অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যা নিরপেক্ষ তদন্তের পথে বড় বাধা। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে, রাজনৈতিক স্বার্থ নিরপেক্ষ বিচার বা বিচার বিভাগের প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য প্রতারণামূলক হবে।
অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনার কারণে স্থানীয় আদালতে প্রদত্ত কোনো সাজা কার্যকর করা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে, ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতা করতে বাধ্য হতে পারে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম সংবিধির ১৫ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলায় শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে, এটি উল্লেখ করে যে মামলার অগ্রগতি নিয়মিতভাবে জানানো হবে। পিটিশনে উল্লেখিত বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে রয়েছে পূর্বপরিকল্পিত হত্যা, গোপন আটকে নির্যাতন, চলাফেরা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ এবং গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধ।
1 Comment