জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়ার ঐতিহ্যবাহী বউমেলা
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে এক দিনব্যাপী ব্যতিক্রমী নারী মেলা বা মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে মেলায় তরুণ-তরুণীরা খুঁজে পায় তাদের জীবনসঙ্গী। উপজাতীয় যুবকদের মধ্যে হৃদয়ের আদান-প্রদান হলে বা তারা একে অপরকে পছন্দ করলে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়।
প্রতি বছর শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর দ্বিতীয় দিনে বসিয়া হাটি নামে পরিচিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মিলনমেলা হয় কোনো রকম প্রচার ছাড়াই। মেলার প্রধান আকর্ষণ সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনসঙ্গী খোঁজা। যার কারণে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী বউমেলা নামে পরিচিত। সন্ধ্যার আগে যুবকরা তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে বাবা-মাকে জানায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্যালেন্ডার দেখে তারিখ নির্ধারণ করা হয়, তারপরে সাক্ষী হিসাবে আত্মীয়দের সাথে উভয় পরিবারের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
এ মেলা উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশের সমন্বয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তাই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এ বছর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মেলা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে বলে দাবি করছে আয়োজক কমিটি।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রতিবছর শরীয়া দুর্গোৎসবের প্রতিমা উৎসর্গের পরদিন ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী মিলন মেলা বসে। তবে এ বছর মেলা আরও একদিন পর উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর যুবকসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ আসেন। মেলায় আসা তরুণীদের বেশির ভাগই কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক এবং চুলের বিনুনিতে মালা দিয়ে তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তরুণরাও পিছিয়ে নেই। মেলায় তারা তাদের প্রিয় জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন।
মেলাটি অনেকের কাছে বাসিয়া হাটি নামেও পরিচিত। আজ মঙ্গলবার দিনব্যাপী এ আদিবাসী মিলন মেলা চলে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা এই মেলায় জড়ো হন। বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার মানুষের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। মেলা উপলক্ষে দু-একদিন আগে থেকেই স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আসেন।
স্থানীয়দের মতে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ তরুণীরা এখান থেকে তাদের পছন্দের পাত্র-পাত্রী খুঁজে পেতে পারে।
এখানে পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন করা হলে পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমে অত্যন্ত ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। যোগ্য বধূরা বরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অভিনব পোশাক এবং বিভিন্ন সাজসজ্জায় নিজেদেরকে সাজান।
সরেজমিনে দেখা যায়, মেলায় সব বয়সী নারী-পুরুষের ভিড়। দোকানিরা সাজিয়ে রেখেছেন রঙিন কাঁচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুক ও মৃৎপাত্র, খেলনা, গৃহস্থালির জিনিসপত্র ও খাবার।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে বিজয়া দশমীর পরদিন প্রতিবছর কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই ‘বসিয়া হাটি’ নামে পরিচিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার প্রধান আকর্ষণ সাঁওতালদের জীবনসঙ্গী খোঁজা।
মঙ্গলবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল মাঠে লোকজন আসতে শুরু করে। সকাল থেকে ভিড় বাড়লেও বিকাল ৩টার পর মূল মেলা শুরু হলেও রাত পর্যন্ত চলে মানুষের আনাগোনা।
মেলায় গিয়ে দেখা যায়, তিল ধারণের জায়গা নেই। তবে ঠিক কবে থেকে মেলা শুরু হয়েছে তা কেউ বলতে পারছেন না। কেউ কেউ বলেন ১০০ বছরেরও বেশি। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘অনেক দিন ধরে’ এই মেলা চলছে। সাঁওতাল যুবকরা তাদের কাঙ্খিত জীবনসঙ্গীর খোঁজে এক বছর অপেক্ষা করে।
জীবনসঙ্গী খোঁজাটাই মূল উপলক্ষ হলেও মেলায় পাওয়া যাচ্ছে নানা পণ্য। বাহারি কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুকের নেকলেস, মাটির খেলনা, গৃহস্থালির সরঞ্জাম, কুড়াল, হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন খাবারের স্টল। ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের আসর চলতে থাকে সঙ্গীতের তালে। আর স্কুল মাঠের একপাশে চলছে পাত্রী বাছাইয়ের কাজ।
সাঁওতাল মেয়েরা বাহারি সাঁজের রঙিন পোশাক পরে মেলায় এসেছে। গলায় ও মাথায় সুন্দর ফুলের বিন্যাস নজর কাড়ে। তাদের চোখ রুমাল বাঁধা হাতে। বিপরীত লিঙ্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তরুণ-তরুণীরা হাতে রুমাল নিয়ে মেলায় আসেন। সন্ধ্যার আগে সঙ্গীকে বেঁধে ফেলতে হবে তাই।
একসময় কনেকে পছন্দ হলে বর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেত। যদিও এটি এখন আর প্রথা নয়, সাঁওতাল যুবকরা তাদের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের জন্য মেলায় ভিড় করে। অভিভাবকও উপস্থিত আছেন। বউ নির্বাচনের উৎসব চলে গানের তালে তালে।
সময়ের সাথে সাথে এই প্রক্রিয়াটিও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন বিয়ে শুধু প্রেম নয়। বরং পছন্দ হলে তা অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হয়। বাবা-মা রাজি হলেই বিয়ে শুরু হয়।
এক সময় এ মেলার নাম ছিল বউমেলা। এখন এই মেলা মিলন মেলা নামে পরিচিত। বাপ-দাদারা এই মেলা শুরু করেছিলেন।
আমরা এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখছি। তবে ঠিক কবে থেকে এই মেলা শুরু হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। আব্বা-দাদার কাছে শুনেছি যুগ যুগ ধরে এই মেলা চলে আসছে। আমরা শুধু বাপ দাদার পথ ধরে আনুষ্ঠানিকতা চালিয়ে যাচ্ছি। বছরে অন্তত একবার এই মেলাকে ঘিরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আত্মীয়-স্বজনরা এই এলাকায় মিলিত হন।
আরো পড়ুন