বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কী?
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সামরিক শাসনের সব চিহ্ন মুছে দিলেও সামরিক ফরমানবলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সব সময় অটুট রেখেছেন। বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলায়, ৫২ ডিএলআর (এডি) ৮২, সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার ওপর দীর্ঘ রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়।
বিচারকেরা যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা গুরুতর অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে তাদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত এ কাউন্সিল বিচারকদের আচরণবিধিও নির্ধারণের কাজ করবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর দফায় বলা আছে, একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকবে, যা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলে উল্লিখিত হবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুজন কর্মে প্রবীণ তাঁদের নিয়ে গঠিত হবে।
এই পদ্ধতিতে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময় কাউন্সিলের সদস্য এ রকম কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অসমর্থ হন, তাহলে কাউন্সিলের যাঁরা সদস্য আছেন, তাঁদের মধ্যে পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কাজ করবেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাজ
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ (৪) অনুসারে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দুই ধরনের দায়িত্ব রয়েছে:
১. বিচারকদের জন্য আচরণবিধি (Code of Conduct) প্রণয়ন এবং
২. বিচারকগণের আচরণ ও সামর্থ্য সংক্রান্তে তদন্ত করা
বিগত ৭ই মে ২০০০ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব লতিফুর রহমান, বিচারপতি বি বি রায় চৌধুরী ও বিচারপতি জনাব এ এম মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথমবারের মতো আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া, আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৩৯টি এবং মো. ইদ্রিসুর রহমান বনাম সৈয়দ শাহিদুর রহমান, ৬৮ ডিএলআর (এডি) ২৫৮, মামলায় ৪০টি আচরণবিধি নির্ধারণ করেন। ইদ্রিসুর রহমান মামলায় আদালত উল্লেখ করে যে, প্রদত্ত আচরণবিধিসমূহ চূড়ান্ত নয় বরং ব্যাখ্যামূলক ও উদাহরণ স্বরূপ। একজন বিচারককে শত বছরের প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন ও নীতি-নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।
বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আপিল নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ড.সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, রাষ্ট্র সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে আপিল খারিজ করে দেন।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ১ আগস্ট, ২০১৭ প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ছিল। এই ক্ষমতা ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছিল। এই ক্ষমতা ১৯৭৭ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে দেওয়া হয়েছিল, যা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
২০০৫ সালে খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কসের মামলায় হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ তা বহাল রাখেন। তবে আপিল বিভাগ বৃহত্তর স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বহাল রেখেছেন।
২০১১ সালে, পঞ্চদশ সংশোধনী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানগুলি অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় পরিষদ দ্বারা পাস হয়েছিল। ২০১৪ সালে, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট এটিকে অবৈধ ঘোষণা করেন।