রাষ্ট্র কখন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে?
সম্পদ বাজেয়াপ্ত
সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা বা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হল কর্তৃপক্ষের দ্বারা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার একটি রূপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এটি এক ধরনের ফৌজদারি-ন্যায়বিচারের আর্থিক বাধ্যবাধকতা। এটি সাধারণত অপরাধের অভিযুক্ত অর্থ বা উপকরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা দুর্নীতি দমন কমিশন যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নগদ বা ব্যাংকের টাকা বাজেয়াপ্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ থাকতে হবে।
এখন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও মানি লন্ডারিংয়ের অবিশ্বাস্য তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, যাদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, নাসা গ্রুপসহ বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব ব্যবসায়ী গ্রুপ শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। একই সঙ্গে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির জোরালো অভিযোগও উঠেছে।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতেই দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের দাবি জোরালো হচ্ছে। এরই মধ্যে হাসিনা সরকারের কিছু প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে কবে রাষ্ট্র সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সম্পর্কে।
সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা কি?
সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা একটি বহুমুখী আইনি ধারণা যা অপরাধমূলক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত বলে বিশ্বাস করা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা জড়িত। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি দ্বারা শুরু হয় এবং এতে নগদ, যানবাহন, রিয়েল এস্টেট এবং এমনকি ডিজিটাল সম্পদ সহ বিস্তৃত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল অপরাধমূলক উদ্যোগগুলিকে তাদের অর্জিত লাভ থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাহত করা এবং বাধা দেওয়া।
একটি কোম্পানির একাধিক মালিক থাকতে পারে। আদালতে যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয় তার সম্পত্তি আদালত বাজেয়াপ্ত করে। সেক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়।
দেশের আইনে অপরাধের ধরন অনুযায়ী কোম্পানির মালিকদের বিচার বা শাস্তির বিধান রয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, সব অপরাধে সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয় না। এ ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের বিধানও আইনে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আইনজীবীরা।
তদন্ত প্রক্রিয়া
আইনজীবীরা বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত কি না তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্নভাবে তদন্ত করা যেতে পারে।
দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার- এই বিষয়গুলো সাধারণত কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়।
আমাদের দেশের দুর্নীতিবাজ সম্পদ অনুসন্ধানের একমাত্র এখতিয়ার দুদকের। কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির তথ্য থাকলে তিনি তা দুদকে জানাতে পারেন। কিন্তু নিজ উদ্যোগে কেউ কিছু করতে পারে না। দুদক অভিযোগ গ্রহণ না করলে বিশেষ আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন যখন দুর্নীতির মামলা নেয় তখন তারা কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে।
দুদকে মামলা দায়েরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হচ্ছে মৌলিক তথ্য অনুসন্ধান, দুদক আইন অনুযায়ী সাক্ষ্য পাওয়ার পর নিয়মিত মামলা করে। দুদকের মামলাটি বিশেষ আদালতে যায়, যেখানে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, এরপর বিচার শুরু হয়
আমাদের ঐতিহ্যবাহী ফৌজদারি ব্যবস্থা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে ভুগছে। সব ভুক্তভোগী। কিন্তু যেহেতু এ বিষয়ে ফৌজদারি বিচারের একমাত্র এখতিয়ার দুদকের, সেহেতু তাদের আর কোনো কাজ নেই; সেক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে গতি আনলে তারা দ্রুত আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন। তাহলে দ্রুত কাজ করা যাবে। কিন্তু যেহেতু এটা সম্পদের ব্যাপার, অনেক প্রমাণের ব্যাপার, কিছু সময়ের প্রয়োজন।
, মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন, অর্থাত্ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগের ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা যেতে পারে।ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তদন্ত ও অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাত মাস পর্যন্ত টাকা রাখতে পারে।
দুই ধরনের টাকা বাজেয়াপ্ত করা যায়- নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা। জব্দকৃত বা বাজেয়াপ্ত টাকা কোথায় নেওয়া হয়েছে, প্রক্রিয়া কী?
টাকা জব্দ করার পর মামলা হলে দুদক, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অর্থের তথ্য আদালতে উপস্থাপন করতে হয়। নগদ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে, আদালত নির্ধারণ করে যে অর্থ কোথায় এবং কার হেফাজতে রাখা হবে।
যে প্রতিষ্ঠানে বাজেয়াপ্ত টাকা রাখা হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কোন ব্যাংক বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা-কে স্বাক্ষর করে বিষয়টি আদালতকে জানাতে হবে।
মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জব্দ করা টাকা কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।
যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং তা আদালতের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়, জব্দ করা অর্থ রাষ্ট্রের কাছে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
জব্দকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা থাকলেও, রাষ্ট্র সেই অর্থ ব্যয় করতে পারে না, যতক্ষণ না আদালত এ বিষয়ে রায় দেয় এবং রাষ্ট্রকে জব্দকৃত অর্থ ব্যবহার করার অনুমতি দেয়।
অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে আদালতের রায় সাপেক্ষে জব্দ করা অর্থ ফেরত পেতে পারেন।
এই অর্থ বা সম্পদ কি সরকারের আয়?
জব্দকৃত টাকা বা সম্পদ সাধারণত মামলায় প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে মামলার রায় রাষ্ট্রের পক্ষে গেলে জব্দকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় অ্যাকাউন্টে বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থাৎ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়।
মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হয়। এ ক্ষেত্রে সাজা হলে অপরাধীর ৪-১২ বছরের জেল হতে পারে।
তবে অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা জব্দকৃত পরিমাণের দ্বিগুণ পর্যন্ত হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমাকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় আয় বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই অর্থ তখন প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যয় করতে পারে।